অথবা, ভারতীয় দর্শন বলতে কী বুঝ? এর বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, ভারতীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : দর্শন এর সঠিক অর্থ হলো সত্যকে দেখা, তত্ত্বকে দেখা এবং এর স্বরূপ উপলব্ধি করা। তাই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ, যুক্তিতর্ক, উপলব্ধি বা প্রজ্ঞার মাধ্যমে জ্ঞানান্বেষণকে দর্শন বলে। জ্ঞানান্বেষণ কর্মটি বিষয় নির্ভর। আমরা জানতে চাই ইন্দ্রিয় গোচর নিসর্গ জগৎ ও মনোজগৎ সম্পর্কে। আবার এ দু’য়ের বাইরে অতীন্দ্রিয় বা আধ্যাত্মিক জগৎ সম্বন্ধে আমাদের জিজ্ঞাসা অসীম। প্রকৃতপক্ষে, জানলে আর জ্ঞান স্পৃহা থাকে না, এমন চরম বা পরমজ্ঞানকে আমরা জানতে চাই। পরমজ্ঞান বা পরমতত্ত্ব সম্পর্কে পরমসত্য জ্ঞানান্বেষণকে দর্শন বলে।
ভারতীয় দর্শন : ভারতীয় দর্শন হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের জীবন ও জগৎ থেকে উদ্ভূত কতকগুলো মৌলিক সমস্যা ও তার যৌক্তিক অনুসন্ধান। এককথায়, ভারতীয় দর্শন হচ্ছে এ উপমহাদেশের জীবন ও জগৎকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঋষি-যোগীর কাছে যে মৌলিক প্রশ্ন উঠেছে এর যৌক্তিক অনুসন্ধান।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : নিম্নে ভারতীয় দর্শনের কয়েকটি সংজ্ঞা দেয়া হলো :
দার্শনিক অর্জুন বিকাশ চৌধুরী তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন যে, “প্রাচীন যুগ থেকে অদ্যাবধি ভারতবর্ষের হিন্দু, অহিন্দু, আস্তিক, নাস্তিক সর্বশ্রেণীর চিন্তাবিদদের বিভিন্ন দার্শনিক সমস্যা সম্পর্কে সমস্ত মতবাদ ভারতীয় দর্শন। ভারতীয় দর্শন বলতে ভারতবর্ষের সমগ্র তত্ত্বচিন্তাকেই বুঝায়।” আবার দার্শনিক জগদীশ্বর তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থের তৃতীয় ও চতুর্থ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “ভারতীয় দর্শন কথাটির
অর্থ সবার কাছে সুস্পষ্ট নয়। কারণ এ কথাটির দুটি অর্থ হতে পারে। ১. ভারতীয় ভৌগোলিক সীমারেখার অধীনে চিন্তাবিদগণের বিশ্ব ব্যবস্থা সম্বন্ধীয় যাবতীয় সমস্যাবলির প্রেক্ষিতে সুচিহ্নিত অভিমতকে বুঝাতে পারে। ২. ভারতীয় ভৌগোলিক সীমারেখার অন্তর্ভুক্ত চিন্তাবিদগণের দ্বারা জগৎ জীবন সম্বন্ধীয় চিহ্নিত সমস্যাবলির প্রেক্ষিতে সুচিন্তিত মতামতকে ভারতীয় দর্শন বুঝাতে পারে।” সুতরাং ভারতীয় সীমারেখার অন্তর্গত সকল মনীষীদের বিশ্ব সম্বন্ধে চিহ্নিত সমস্যাবলির প্রেক্ষিতে তাঁদের সুচিন্তিত
মৌলিক পরমতত্ত্ব সম্বন্ধীয় যে আলোচনা, ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন বা সত্যানুসন্ধান তাকে ভারতীয় দর্শন বলে।
ভারতীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্য : ভারতীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. সম্প্রদায় নির্ভর : স্বরূপত ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস প্রায় একান্তভাবেই সম্প্রদায় নির্ভর। এখানে অতীতে যেসব সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল, পরবর্তীকালে কেবল তাদেরই বিকাশ ঘটে। আর এ বিকাশের মধ্যেই ভারতীয় দর্শনের ঐতিহ্য নিহিত। এখানে একই সাথে বা প্রায় পাশাপাশি যতগুলো সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ঘটেছে, ক্রমানুসারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ বা স্বাধীন কোন দার্শনিক মতের উদ্ভব ততটা ঘটে নি। এর অর্থ এটা নয় যে, এখানে কোন অসামান্য দার্শনিক প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে নি।
২. রচনাশৈলীর বিশিষ্টতা : রচনাশৈলীর স্বকীয়তা ভারতীয় দর্শনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখানকার দার্শনিকদের রচনাশৈলীর মধ্যে বিভিন্ন মতের দ্বন্দ্ব বা সংঘাত যে কত মৌলিকভাবে তাঁদের চিন্তাধারাকে রূপায়িত করেছে তা বুঝা যায় । ভারতীয় দার্শনিকদের রচনারীতি তিনটি ক্রমে বিন্যস্ত। যথা : পূর্বপক্ষ, নিরাকরণ ও সিদ্ধান্ত। এখানে প্রথমে প্রতিপক্ষের মতকে শ্রদ্ধার সাথে শ্রবণ করা হয়, এরপর যুক্তির শাণিত অস্ত্রে প্রতিপক্ষের মতের নিরাকরণ করা হয় এবং সর্বশেষে.নিজের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করা হয়।
৩. ধর্মের সাথে দর্শনের সংযোগ : ভারতীয় সংস্কৃতিতে ধর্ম ও দর্শনে
র এক অবিচ্ছেদ্য সংযোগ লক্ষ্য করা যায়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় অধিকাংশ সম্প্রদায়ই ধর্ম ও দর্শনকে এক চোখে দেখেছেন। ভারতীয় দার্শনিকেরা চিন্তার মহান স্তরে উন্নীত হয়ে ধর্ম ও দর্শন এ দুটিকে পরস্পর প্রতিপক্ষ না ভেবে একপক্ষ ভেবেছেন। দর্শন ও ধর্মের একই মঞ্চে.সহাবস্থান ঘটেছে।
৪. অতীতাশ্রয়ী : ভারতীয় দর্শন যেহেতু একান্তভাবেই সম্প্রদায় নির্ভর, সে কারণেই তা বহুল পরিমাণে অতীতাশ্রয়ী। ভারতীয় দর্শন অতীতকে বর্জন করে সামনে এগুতে পারে নি বা চেষ্টাও করে নি। সে কারণে ভারতীয় দর্শনের আধুনিক ব্যাখ্যাও প্রাচীন। এরই ফলে ভারতীয় দার্শনিকেরা প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাস ও পৌরাণিক কল্পকাহিনীর সাথে অপেক্ষাকৃত জটিল, গভীর ও উন্নতমানের দার্শনিকতার সহাবস্থান ঘটাতে সমর্থ হয়েছেন।
৫. সূত্র নির্ভরতা : ভারতীয় দর্শনের মৌলিক সূত্র সাহিত্যের উপর অধিক পরিমাণে নির্ভরশীল। ভারতীয় দর্শনের প্রচলিত ইতিহাসে যেসব সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাদের সবার মূলগ্রন্থেই এক একটি সূত্র সংকলনের অস্তিত্ব দেখা যায়। এসব সূত্র অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত, অপূর্ণাঙ্গ ও অস্পষ্ট হওয়ায় উত্তরকালে এদের উপর বিভিন্ন ভাষ্য ও টীকার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়।
৬. জীবনের সাথে সংযোগ : ভারতীয় দার্শনিকেরা জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনে দর্শন চর্চার গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। জীবনকে যথার্থভাবে পরিচালনা করা ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দর্শন চর্চা যে অত্যাবশ্যক এ কথাটি ভারতীয় দর্শনের সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট ছিল। তাই ভারতীয়দের কাছে দর্শন কেবল তত্ত্বালোচনা বা কৌতূহল নিবৃত্তি নয়, দর্শন হলো দূরদৃষ্টির সহায়তায় জীবনকে সঠিক ও সার্থক পথে চালনা ও নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি।
৭. আধ্যাত্মিক অশান্তি : আধ্যাত্মিক অশান্তি বা অতৃপ্তিই ভারতীয় দার্শনিকদের দর্শন চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছে। ভারতীয় দার্শনিকদের মাঝে এটা লক্ষণীয় যে, তাঁরা জীবনের ব্যবহারিক দিকটার উপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। তাই তাঁরা জীবনের দুঃখদুর্দশার কথা ভুলতে পারেন নি। এ কারণে বৌদ্ধ, সাংখ্য, যোগ প্রভৃতি দর্শনে দুঃখবাদের চিত্র সুস্পষ্ট। এ দুঃখবোধ তথা আধ্যাত্মিক অশান্তি থেকে উত্তরণ করতেই ভারতীয় দার্শনিকরা দর্শন চর্চায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
৮. জীবনাদর্শন হিসেবে মোক্ষ : চার্বাক ভিন্ন ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য সম্প্রদায় মোক্ষকে জীবনাদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ভারতের অধিকাংশ দার্শনিক তাই মোক্ষলাভের আশায় অধিক মাত্রায় ব্যস্ত। ভারতীয় দর্শনে মোক্ষ মানে জাগতিক দুঃখকষ্ট থেকে পরিত্রাণ ।
৯. কর্মবাদের স্বীকৃতি : এক শাশ্বত নৈতিক বিধানের অস্তিত্বে বিশ্বাস ভারতীয় দর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। চার্বাক ভিন্ন সকল সম্প্রদায় এ নৈতিক বিধানে আস্থাশীল। আসলে ভারতীয় দুঃখবাদের মূলভিত্তি হলো কর্মবাদ। আর কর্মবাদের মূলনীতি হলো মানুষের ভাগ্যই তার কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে।
১০. জন্মান্তরবাদের স্বীকৃতি : কর্মবাদের প্রতি বিশ্বাসই ভারতীয় দার্শনিকদের জন্মান্তরবাদে আস্থাশীল করে তুলেছে এবং কর্মবাদের উপরই জন্মান্তরবাদ প্রতিষ্ঠিত। কর্মবাদে বলা হয়েছে, মানুষ কর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করবে।.ভারতীয় দর্শনে এও বলা হয়েছে যে, মানুষের কৃতকর্মের ফল ভোগ এক জীবনে শেষ নাও হতে পারে। ফলে কর্মফল ভোগের জন্য আবার তাকে পৃথিবীতে নতুন জীবন নিয়ে আসতে হবে।
১১. অবিদ্যার ঘৃণাবোধ : ভারতীয় অধিকাংশ দার্শনিকগণ অবিদ্যা বা অজ্ঞানতাকে ঘৃণার চোখে দেখেছেন। তাঁদের মতে, অবিদ্যা বা অজ্ঞানতাই মানুষের যাবতীয় দুঃখবোধের সক্রিয় ভিত্তিমূল। আত্মার স্বরূপ সম্পর্কিত সম্যক জ্ঞানের অভাবই অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা। চার্বাক ব্যতীত অন্যান্য সকল সম
্প্রদায় বিশ্বাস করেন যে, সম্যক জ্ঞানই অবিদ্যা বা অজ্ঞানতাকে বিনাশ করে জীবনকে দুঃখদুর্দশা থেকে মুক্ত করতে পারে।
১২. ধ্যান ও নৈতিক জ্ঞানের উপর গুরুত্বারোপ : অবিদ্যা বা অজ্ঞানতাকে বিনাশ করার জন্য প্রায় সকল ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় ধ্যান ও নৈতিকতার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। জৈন, বৌদ্ধ, সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক ও বেদান্ত দর্শনে যোগসাধনার কথা বলা হয়েছে। যোগসাধনার জন্য ঐকান্তিক নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও কঠোর সাধনা অত্যাবশ্যক।
১৩. জগৎকে রঙ্গমঞ্চ হিসেবে অনুভব : পার্থিব জগৎকে একটি নৈতিক রঙ্গমঞ্চ হিসেবে উপলব্ধি ভারতীয় দার্শনিক অনুসন্ধিৎসার অপর একটি স্বীকৃত বৈশিষ্ট্য। মূলত কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসই ভারতীয় দার্শনিকদের ইহলৌকিক জগৎকে নৈতিক রঙ্গমঞ্চ হিসেবে কল্পনা করতে প্রলুব্ধ করেছে।
১৪. অন্তলোকের উপর গুরুত্বারোপ : বাইরের জগতের তুলনায় অন্তর্জগতের উপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ ভারতীয় দর্শনের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। চার্বাক ও বৌদ্ধ ব্যতীত সকল ভারতীয় দর্শনের বেলায় এ কথাটি প্রযোজ্য ।
১৫. জ্ঞানার্জনে এক বা একাধিক প্রমাণের স্বীকৃতি : জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে এক বা একাধিক প্রমাণের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি ভারতীয় দর্শনের অপর একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। চার্বাক ভিন্ন ভারতীয় দর্শনের প্রায় সকল সম্প্রদায়ই একই সাথে একাধিক প্রমাণে আস্থাশীল। এর অর্থ ভারতীয় দার্শনিকদের কোন সম্প্রদায়ই প্রমাণ ব্যতিরেকে জ্ঞানচর্চাকে বৈধ বলে মনে করেন
না। এ বৈশিষ্ট্যের কারণে ভারতীয় দর্শনকে নির্বিচার দর্শনের অভিযোগ থেকে সফলভাবে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, ভারতীয় দর্শনে সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, বেদান্ত, চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি দার্শনিক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটেছিল। অতি প্রাচীন হিন্দু দার্শনিক মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শ সংগ্রহ’ গ্রন্থে এসব সম্প্রদায়ের দর্শন আলোচনা করেছেন। ভারতীয় দর্শনের এ উদার এবং ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় দার্শনিকদের অপূর্ব সত্যানুসন্ধিৎসার ও বিচারনিষ্ঠার পরিচয় প্রদান করে। ভারতীয় দার্শনিকদের উদার মনোভাব এবং অন্যের বক্তব্য । ভারতীয় দর্শনের বিশালত্বের ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রধান কারণ।

ডিগ্রী অনার্স মাস্টার্স পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে পেতে Whatsapp এ ম্যাসেজ করুন। Whatsapp 01979786079