অথবা, ভারতীয় দর্শনের স্বরূপ আলোচনা কর।
অথবা, ভারতীয় দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ভারতীয় দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্পর্কে বর্ণনা কর।
উত্তরায় ভূমিকা :
ভারতীয় দর্শনকে অনেকে ‘হিন্দু দর্শন’ নামেও অভিহিত করেন। কিন্তু ভারতীয় দর্শন ও হিন্দু দর্শন সমার্থক নয়। অবশ্য হিন্দু বলতে যদি কোন সম্প্রদায়কে না বুঝে ভারতীয় বুঝি তাহলে ভারতীয় দর্শনকে হিন্দু দর্শন বলা যেতে পারে। কিন্তু হিন্দু বলতে আমরা আসলে একটি সম্প্রদায়কে বুঝি। তাই ভারতীয় দর্শনকে ‘হিন্দু দর্শন’ নামে অভিহিত করা কোন মতেই যুক্তিযুক্ত নয়।
ভারতীয় দর্শনের প্রকৃতি : একটি শাস্ত্রের আলোচ্যবিষয়ের সারবস্তুর ভিত্তিতে গড়ে উঠে সে শাস্ত্রের প্রকৃতি। ভারতীয় দর্শনও এর ব্যতিক্রম নয়। নিম্নে ভারতীয় দর্শনের বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে এর প্রকৃতি আলোচনা করা হলো :
১. ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি : ভারতীয় দর্শনের প্রকৃতি আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের প্রথমেই বলতে হয় যে, ভারতীয় দর্শনের প্রকৃতি হলো ব্যবহারিক। ভারতীয় দর্শন জ্ঞানের খাতিরে জ্ঞান নয়, বরং মানুষের ব্যবহারিক চাহিদা পূরণের জন্যই জ্ঞান অর্জনে ব্রতী হয়। দর্শন শুধু জ্ঞান আহরণ নয়, এ হলো জীবন চলার পাথেয়। ভারতীয় প্রায় সকল সম্প্রদায়ই মানুষের জীবনের দুঃখকষ্ট দেখে তা থেকে পরিত্রাণের পথ আবিষ্কারের জন্য দর্শন চর্চা করেছেন।
২. বেদ সম্পৰ্কীয় আলোচনা : ভারতীয় দর্শনের একটি অন্যতম প্রকৃতিগত বিষয়বস্তু হলো বেদ সম্পৰ্কীয় আলোচনা। ভারতীয় সকল দার্শনিক সম্প্রদায়ই বেদ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তবে বেদ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলোর কোনটি বেদকে স্বীকার করেছে, আবার কোনটি অস্বীকার করেছে। যেসব দার্শনিক সম্প্রদায় বেদকে স্বীকার করেছে তাদের দর্শনকে আস্তিক দর্শন বলা হয়। যেমন- ন্যায়, যোগ, মীমাংসা সম্প্রদায়; আর যারা অস্বীকার করেছে তাদেরকে নাস্তিক সম্প্রদায় বলা হয়। যেমন- চার্বাক, জৈন এবং বৌদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায়।
৩. দুঃখবাদ : ভারতীয় দর্শনের একটি অন্যতম প্রকৃতি হলো এর দুঃখবাদী আলোচনা। ভারতীয় প্রায় সব দর্শনই কম বেশি দুঃখকে স্বীকার করেছে। এ প্রসঙ্গে গৌতম বুদ্ধ নিজেই বলেছেন, “পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ যে পরিমাণ অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে তার সাথে সমগ্র পৃথিবীর সমগ্র সাগরের সমস্ত জলেরও তুলনা হয় না।”
৪. সনাতন নৈতিক নিয়মে বিশ্বাস : ভারতীয় দর্শনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, একমাত্র চার্বাক দর্শন ব্যতীত প্রায় সকল ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় এক সনাতন নৈতিক নিয়মে বিশ্বাসী। ঋগ্বেদের ঋষিরা এ নিয়মকে ‘ঋত’ বলেছেন, যা পরবর্তীকালে কর্মবাদ নামে অভিহিত। এ নৈতিক নিয়মে বিশ্বাস করে বলেই ভারতীয়গণ নিজেকে আপন ভাগ্যের স্রষ্টা বলে মনে করেন। ভারতীয়গণ বিশ্বাস করেন যে, প্রত্যেককেই তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হবে।
৫. আধ্যাত্মিক অস্বস্তি : আধ্যাত্মিক অস্বস্তিবোধ ভারতীয় দর্শনের এক অন্যতম প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। এ আধ্যাত্মিক অস্বস্তিবোধ থেকেই ভারতীয় দর্শনের উদ্ভব হয়েছে।
৬. বিচারবাদী : বিচারবাদিতা ভারতীয় দর্শনের প্রকৃতিকে অনন্যতা দান করেছে। ভারতীয় সকল দার্শনিক সম্প্রদায়ই বিচারবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। এমনকি বেদকে যেসব দার্শনিক সম্প্রদায় প্রামাণ্য রূপে গ্রহণ করেছে তারাও উক্ত প্রমাণকে বিনাবিচারে গ্রহণ করে নি, বরং স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেই তারা এর প্রমাণকে গ্রহণ করেছে।
৭. আশাবাদ : ভারতীয় দর্শনের শুরুতে দুঃখ থাকলেও পরবর্তীতে দুঃখ থেকে পরিত্রাণ তথা আশার বাণী শুনিয়েছে, যাকে ভারতীয় দর্শনের মূল প্রকৃতি বলা য ায়। ভারতীয় প্রত্যেকটি দার্শনিক সম্প্রদায়ই দুঃখ থেকে পরিত্রাণের কথা বলেছে। ভারতীয় দার্শনিকগণ বলেছেন, দুঃখ আছে বলেই দুঃখ থেকে পরিত্রাণের জন্য দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান প্রভৃতির সৃষ্টি হয়েছে।
৮. আলোচনার পদ্ধতি : ভারতীয় দর্শনের একটি প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য হলো এর দার্শনিক আলোচনার এক অভিনব পদ্ধতি। কোন সমস্যা সম্পর্কে কোন ভারতীয় দার্শনিক কখনই তার নিজের মত প্রথমে প্রকাশ করতেন না, বরং এ সম্পর্কে তার পূর্ববর্তী দার্শনিকদের মত আলোচনা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও খণ্ডন করতেন। একে ভারতীয় দর্শনে পূর্বপক্ষ বা নিরাকরণ বলা হয়। তারপর তিনি যুক্তিতর্কের মাধ্যমে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতেন, যাকে ভারতীয় দর্শনে উত্তরপক্ষ বা সিদ্ধান্ত বলা হয় ।
৯. সংযোগাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি : সংযোগাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় দর্শন আলোচনার এক অন্যতম প্রকৃতি। ভারতীয় দর্শনেও পাশ্চাত্য দর্শনের ন্যায় যুক্তিবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা, মনোবিদ্যা, জ্ঞানবিদ্যা, নীতিবিদ্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনে যেভাবে পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করা হয়েছে, ভারতীয় দর্শনে সেভাবে করা হয় নি। বিভিন্ন শাস্ত্রের সমস্যাগুলো পরস্পর সম্পর্কিত বলে কোন একটি দার্শনিক সমস্যাকে ভারতীয় দার্শনিকগণ জ্ঞানবিদ্যা, মনোবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি সম্ভাব্য সকল দিক থেকে আলোচনা করেছেন।
১০. দর্শন ও জীবনের সম্পর্ক : ভারতীয় দর্শনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এটি জীবনের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়সমূহ দর্শনের ব্যবহারিক দিকের উপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। জীবনকে যথাযথভাবে পরিচালনা করার জন্য দর্শন অনুশীলন যে প্রয়োজন সে কথা ভারতীয় সকল দার্শনিক
সম্প্রদায়ই স্বীকার করেছে।
১০. মোক্ষ বা মুক্তিলাভ : ভারতীয় দর্শনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মোক্ষ বা মুক্তিলাভই ভারতীয় দর্শনের চরম লক্ষ্য। চার্বাক ব্যতীত প্রায় সকল ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ই মোক্ষলাভকে মানবজীবনের পরম পুরুষার্থ বলে উল্লেখ করেছেন এবং মোক্ষলাভের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
১১. সূত্র নির্ভরতা : ভারতীয় দর্শন মূলত সূত্র সাহিত্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে যেসব সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাদের সবার মূলগ্রন্থেই এক একটি সূত্র সংকলনের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।
১২. জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস : কর্মবাদের উপর বিশ্বাসই ভারতীয় দার্শনিকদের কর্মবাদে আস্থাশীল করে তুলেছে। কর্মবাদে বলা হয়েছে মানুষ কর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করবে। ভারতীয় দর্শনেও বলা হয়েছে যে, কৃতকর্মের ফল ভোগ এক জীবনে শেষ নাও হতে পারে। ফলে কর্মফল ভোগের জন্য আবার তাকে নতুন জীবন নিয়ে পৃথিবীতে আসতে হয়। কর্ম ও ফলভোগের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই কর্মফল কখনো ধ্বংস হয় না। কর্মফল ভোগ একজীবনে শেষ না হলে নতুন জীবন নিয়ে পৃথিবীতে আসতে হয়। কারণ কর্মের নৈতিক মূল্য সংরক্ষিত থাকে।
১৩. অন্তর্মুখী : ভারতীয় দর্শনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ভারতীয় দর্শন অন্তর্মুখী। একমাত্র চার্বাক দর্শন ব্যতীত প্রায় সকল দার্শনিক সম্প্রদায় অন্তর্জগতের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতীয় দর্শনের প্রকৃতি জ্ঞানবাদী, ব্যবহারিক, অন্তর্মুখী ভারতীয় দর্শনের এ প্রকৃতি তাকে অন্যান্য দর্শন থেকে পৃথক করে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। ভারতীয় দার্শনিকগণ শুধু জ্ঞানের পিপাসা নিবারণের জন্য দর্শন চর্চা করেন নি, বরং মানুষের ব্যবহারিক জীবনের চাহিদা পূরণ, আত্মার মুক্তি, আধ্যাত্মিক প্রশান্তি সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটন, জগত ের স্বরূপ উপলব্ধি, ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ সর্বোপরি মানবকল্যাণ সাধন ছিল তাদের উদ্দেশ্য। যা এর প্রকৃতির মধ্যে ফুটে উঠে। আর এ কারণেই ভারতীয় দর্শন তার নিজস্ব চরিত্রে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a5%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%a6%e0%a6%b0/
admin

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!