General Knowledge

ব্রিটিশ শাসন আমলে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব কিভাবে, কোন পরিস্থিতিতে হয় আলোচনা কর ।

অথবা, ব্রিটিশ শাসন আমলে সাম্প্রদায়িকতার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।
অথবা, উপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও এর ফলাফল ব্যাখ্যা কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা :
ভারত উপমহাদেশ একটি বিশাল সাম্রাজ্য। এতে বিভিন্ন ধর্মের, বর্ণের, শ্রেণি, পেশার মানুষ রয়েছে। পূর্বে অনেক ধর্মের রাজা তাকে শাসন করেছে। এক দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে বসবাস করেছে এবং তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা তেমন দৃশ্যমান ছিল না, কিন্তু ব্রিটিশ শাসন আসার পরে এ দৃশ্য বদলে যায় । বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে, ঘনীভূত হতে থাকে সাম্প্রদায়িকতার বিষপাষ্প। এর শেষ পরিণতি হয় ভারত ভাগ ।
সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব বা উৎপত্তি : ভারতের দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় হলো হিন্দু ও মুসলমান। মূলত ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতের এ দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ হয় এবং ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। এর পূর্বে উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিয়ে গড়ে উঠে ভারতের স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনিয়ন্ত্রিত গ্রামীণ সমাজ। যুগ যুগ ধরে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে পাশাপাশি বসবাস করে তারা, প্রায় পাঁচশ বছরব্যাপী মুসলমান শাসন আমলেও এ অবস্থা অক্ষুণ্ন ছিল। কিন্তু এ অবস্থার পরিবর্তন আসে যখন ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনার উদ্ভব হতে থাকে। এ সাম্প্রদায়িক চেতনার উদ্ভবের পিছনে কিছু কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবের কারণ : নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশদের অবহেলা : যেহেতু ব্রিটিশ মুসলমানদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে ভারতের শাসকে পরিণত হয়। তাই শুরু থেকেই ইংরেজরা মুসলমানদের প্রতি অবহেলা দেখায় এবং হিন্দুদের প্রতি উদার মনোভাব প্রকাশ করে। এর ফলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ব্যবধান চলে আসে।
২. হিন্দু সম্প্রদায়ের সমর্থন আনুগত্য লাভ : ব্রিটিশরা শুরুতে মুসলমানদের শত্রু ছিল কারণ মুসলমানরা তাদের হাতে পরাজিত হয় কিন্তু হিন্দুদের ক্ষেত্রে এতে বিশেষ কোনো ব্যাপার ছিল না শুধু শাসকের পরিবর্তন মাত্র। ব্রিটিশরা শুরু থেকেই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের সমর্থন গোষ্ঠী সৃষ্টি করতে তৎপর হয় এবং এদের মধ্যে হিন্দুরা ছিল উল্লেখযোগ্য। যারা পলাশী যুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্যে করে এবং পরবর্তীতে ইংরেজ শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সাহায্য করে।
৩. ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন : হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্কের অবনতির ক্ষেত্রে ভূমি ব্যবস্থার কথা সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এর ফলে হিন্দু জমিদার মুসলমান প্রজা কৃষকের সম্পর্কের অবনতি হয়। ভূমি ব্যবস্থার ফলে জমিদারদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ সাম্প্রদায়িকতার রূপ লাভ করে।
৪. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে মুসলমান জমিদারদের বিশেষ ক্ষতিসাধন হয়। বহু মুসলমান জমিদার তার জমিদারিত্ব হারায় এবং এর স্থলে আসে নব্য অর্থ উপার্জনকারী হিন্দুদের একটি বড় অংশ।
৫. ইংরেজি শিক্ষা : ব্রিটিশরা আসার পর দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার করতে থাকে। এ কারণে ১৮৩৭ সালে ফরাসির বদলে ইংরেজি ভাষাকে সরকারি ভাষা করা হয়। হিন্দুরা এ পরিবর্তন সহজে গ্রহণ করে এবং সদব্যবহার করে চাকরিবাকরির ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে যায় কিন্তু মুসলমানরা বিধর্মী কোনো ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে গ্রহণ করতে অসম্মতি জানায়। ফলে তারা হিন্দুদের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে। তাই হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যকার অর্থনৈতিক, সমাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন তথা ব্যবধান আসে। এরই মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যেম্ সাম্প্রদায়িকতার বিষবীজ রোপিত হয়। এর প্রধান কারণই ছিল ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্যমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ।
সাম্প্রদায়িকতার ক্রমবিকাশ : ব্রিটিশ আমলের শুরু থেকে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার যে চেতনা উন্মেষ হয় তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এ কারণে ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসেও পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক মনোভাব ঢুকে পড়ে এবং এ কারণে অনেক মুসলমান রাজনীতিবিদ এ থেকে বিরত থাকে।
প্রথম বহিঃপ্রকাশ ১৯০৫ : ভারতের সাম্প্রদায়িকতার প্রথম চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হয় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর। এ সময় ভারতে দুটি সম্প্রদায় তাদের স্বার্থের জন্য চূড়ান্ত দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ভারতীয় হিন্দুরা অখণ্ড বাংলা চাই কিন্তু বাংলার মুসলমানরা তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বাংলা বিভক্তির পক্ষে ছিল। এমনই অবস্থায় দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র মতানৈক্য দেখা দেয়। ১৯১১ সালে কংগ্রেস ও হিন্দুদের তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। এরই মধ্যে ভারতের মুসলমানরা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কংগ্রেস হিন্দু জাতিয়তাবাদী দলের প্রতিপক্ষ হিসেবে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ তৈরি করে। ১৯১১ সালের পর থেকে মুসলমান ও হিন্দু সম্পর্কের আর উন্নতি সম্ভব হয়নি। যদিও ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ চুক্তি এবং ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট এর মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এরই মধ্যে বিভিন্ন সময় হিন্দু-মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিভিন্ন দাঙ্গা হয়। ১৯২৮ সালে নেহেরু রিপোর্ট প্রকাশের পর তা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠে। মুসলমানদের দাবি মেনে না নেওয়ার কারণে মুসলমানরা হিন্দুদের প্রতি তীব্র বিরোধিতা করে। এরই প্রেক্ষিতে জিন্নাহ ১৯২৯ সালে চৌদ্দ দফা পেশ করে। ১৯৩২ সালের ব্রিটিশ সরকারের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ হিন্দু-
মুসলমান সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটায়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর কংগ্রেস মুসলমানদের অবহেলা করে মন্ত্রিসভা গঠন করে। ফলে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি আবার প্রবল ধাক্কা আসে এবং এ প্রেক্ষিতে জিন্নাহ তার বিখ্যাত দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রকাশ করে। দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব পেশ করা হয় যাতে বলা হয় মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্রের কথা। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় যার প্রমাণ বহন করে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ‘ভয়াবহ কোলকাতা দাঙ্গা’। এর অব্যবহিত পরে নোয়াখালী দাঙ্গার পরে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে বিরাট ফাটল ধরে। যা পরবর্তীতে ভারতের বিভক্তিকে অনিবার্য করে তোলে। ১৯৪০ সালের সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধির কারণেই ব্রিটিশ সরকার ভারতকে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ভাবতে শুরু করে এবং এ সাম্প্রদায়িকতার কারণেই ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি হয়ে পাকিস্তান এবং ভারতের সৃষ্টি হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতের এ সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি ও বিকাশের ক্ষেত্রে যতটা না ধর্মীয় কারণ উল্লেখযোগ্য ছিল তার চেয়ে বেশি ব্রিটিশ সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক পদ্ধতি Divide and Rule (ভাগ কর, শাসন কর) দায়ী ছিল। এ সাম্প্রদায়িকতার অনিবার্য পরিণতির ফলে ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!