বৌদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভবের কারণ কী?
অথবা, কী কারণে গৌতম বুদ্ধের অনুসারীরা বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছেন?
অথবা, কোন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বৌদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায়সমূহের আবির্ভাব হয়?
উত্তর৷ ভূমিকা : গৌতম বুদ্ধের বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ এবং জীবন সম্পর্ক যে মতবাদ গড়ে উঠেছে সে মতবাদই বৌদ্ধ দর্শন। বুদ্ধ নিজের আত্মশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষতলে বহু বছর কঠোর তপস্যা করে জগতে দুঃখের রহস্য ও স্বরূপ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুর দুঃখাবহ দৃশ্য দেখে তিনি যে দার্শনিক সত্যের জ্ঞান লাভ করেন তা হলো-এ জগৎ দুঃখে পরিপূর্ণ।
গৌতম বুদ্ধের দার্শনিক ধ্যানধারণা : দর্শনের প্রধান সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য গৌতম বুদ্ধ মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। তার নিকট প্রধান সমস্যা ছিল, মানুষ জগতে দুঃখকষ্ট ভোগ করে কেন এবং এই দুঃখকষ্ট হতে পরিত্রাণ লাভের উপায় কী? মুখ্যত এই দুইটি সমস্যার সমাধানের চেষ্টাতেই বুদ্ধদেব আজীবন সংগ্রাম করেছেন।
জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য : এমন কতকগুলো দার্শনিক সমস্যা আছে যেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলা কোন চিন্ত বিদের পক্ষে সম্ভব নয়। বুদ্ধদেবও তা পারেন নি। প্রশ্নগুলো হলো : জগৎ কী? মানুষ কে? মানুষ এবং জগৎ কোথা থেকে এসেছে এবং কিভাবে এসেছে? ইত্যাদি। এই সমস্যাগুলোর সমাধান ব্যতীত মানুষের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী তা নির্ধারণ করা যায় না।
সবকিছুকে বিচারপূর্বক গ্রহণ : বুদ্ধদেব নির্বিচারে কোন মত গ্রহণ বা কোন পথ অবলম্বন করতেন না। সবকিছুই তিনি বিচারপূর্বক গ্রহণ করতেন এবং তার শিষ্যদেরকেও সবকিছু বিচারপূর্বক গ্রহণ করতে বলতেন। কাজেই বুদ্ধদেবের পক্ষেও বিভিন্ন দার্শনিক সমস্যা সম্পর্কে একেবারে নিশ্চিন্ত থাকা সম্ভবপর হয় নি।
প্রত্যক্ষ দার্শনিক মতবাদ নয় : প্রত্যক্ষভাবে বুদ্ধদেব কোন দার্শনিক মতবাদ প্রচার করেননি। কিন্তু তাঁর নৈতিক উপদেশের মধ্যেই দার্শনিক মতবাদের বীজ সুপ্ত ছিল। কাজেই তাঁর দার্শনিক মতবাদ প্রত্যক্ষ দার্শনিক মতবাদ নয়।
দার্শনিক মতের বিভিন্নতা : বুদ্ধের নৈতিক উপদেশের মধ্যে যে দার্শনিক মতবাদ লুক্কায়িত ছিল তাকে দৃষ্টবাদ বলা যায়, কারণ ইহা দৃষ্ট জগতে সীমাবদ্ধ। এটাকে আভাসবাদ বলা যায় কেননা বুদ্ধদেবের মতে কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও পরিদৃশ্যমান জগৎ সম্পর্ক নিঃসদ্ধি জ্ঞান লাভ করা যায় এবং একে অভিজ্ঞতাবাদও বলা যায়, যেহেতু বুদ্ধদেবের মতে, অভিজ্ঞতাই জ্ঞান লাভের প্রকৃষ্ট উপায়।
বুদ্ধের মতের দার্শনিক ভিত্তি গঠন ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উদ্ভব : গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যবর্গ তার দার্শনিক মতবাদগুলোর বিশদ ব্যাখ্যা ও আলোচনা করে বুদ্ধদেবের নীতিশাস্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি গঠন করেন। বুদ্ধদেবের শিষ্যগণ তাঁর দার্শনিক মতবাদের বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দেন। ফলে প্রায় ত্রিশটি বৌদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। তবে
ভারতীয় দর্শন সাহিত্যে মুখ্য চারটি সম্প্রদায়ের বিবরণ পাওয়া যায়।
বিভক্তির মৌলিক প্রশ্ন : দুটি মৌলিক প্রশ্নকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ দর্শনের চারটি শাখার উদ্ভব হয়। প্রথম প্রশ্নটি হলো- মন বা বাহ্যবস্তু বলে কোন কিছুর সত্তা আছে কিনা? আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, বাহ্যসত্তাকে জানার উপায় কি? এসব প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে বুদ্ধের মতের ভিন্ন ভিন্ন রকম ব্যাখ্যার কারণে বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, গৌতম বুদ্ধ সরাসরি কোন দার্শনিক মতবাদ প্রচার করেন নি এবং দার্শনিক সমস্যাবলির সমাধানের কথাও বলেন নি। তবে তাঁর বিভিন্ন নৈতিকতা উপদেশবাণীর মধ্যে দার্শনিক চিন্তার বীজ নিহিত ছিল। আর বুদ্ধের পরোক্ষ এ দার্শনিক চিন্তার সুস্পষ্ট ব্যাখ
্যা প্রদান করতে গিয়ে বুদ্ধের অনুসারীরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বভক্ত হয়ে পড়েন এবং বুদ্ধের উপদেশবাণীর ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন।