অথবা, বৌদ্ধ দর্শনানুসারে যোগাচার বিজ্ঞানবাদ সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখ।
অথবা, যোগাচার বিজ্ঞানবাদ সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
গৌতম বুদ্ধের (খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দ- খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দ) বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে সে মতবাদই ‘বৌদ্ধ দর্শন’ বা ‘বৌদ্ধধর্ম।’ বুদ্ধদেবের অনুগামীদের সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে এবং বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম ও দর্শনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রায় ত্রিশটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে বলে জানা যায়। এ সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে যোগাচার সম্প্রদায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিম্নে প্রশ্নপত্রের আলোকে যোগাচার বিজ্ঞানবাদ আলোচনা করা হলো :
যোগাচার বিজ্ঞানবাদ : যোগাচার সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হলেন অসঙ্গের গুরুদেব মৈত্রেয়নাথ। যোগাচার দার্শনিকগণ মহাযান ধর্ম সম্প্রদায়ভূক্ত ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, ‘যোগাচার মতাবলম্বী দার্শনিকগণ যোগ এবং সদাচারের মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করা যায়’-এ মত পোষণ করে বলে এই মতবাদকে যোগাচারবাদ বলা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন, যোগাচার সম্প্রদায়ভূক্ত দার্শনিকগণ বাহ্যবস্তুর অসত্যতাকে উপলব্ধি করার জন্য যোগাভ্যাস করতেন বলে তাঁদের দর্শনের নাম যোগাচার দর্শন। যোগাচার দর্শনকে বিজ্ঞানবাদ বলা হয়। S. Chatterjee and D. Datta তাঁদের An Introduction to Indian Philosophy, “The Yogācāra view is called Vijnana-vāda because it admits vijnana or consciousness as the only reality.” (Page-149) যোগাচার বিজ্ঞানবাদ অনুসারে বিজ্ঞান বা চেতনাই একমাত্র সৎ
বস্তু। ‘বিজ্ঞান’ শব্দটির অর্থ হলো ‘বিশেষ জ্ঞান’। কিন্তু ভারতীয় দর্শনে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটি সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে চেতনা অর্থে ব্যবহৃত হয়। লঙ্কাবতারসূত্র এই দর্শনের একটি উল্লেযোগ্য গ্রন্থ। কমলশীল-এর ভাষ্যসহ শান্ত রক্ষিত-এর তত্ত্বসংগ্রহ যোগাচার দর্শনের আর একটি পাণ্ডিত্বপূর্ণ গ্রন্থ। যোগাচার বিজ্ঞানবাদ চেতনাকে সত্য বলে জানে। জ্ঞান নির্বস্তুক
এবং নিরালম্ব । বাহ্যবস্তুর সত্তা চেতনায়। প্রত্যক্ষের বাইরে বস্তুর কোন সত্তা নেই। জ্ঞান-ই জ্ঞেয়। অন্তর্জেয় জ্ঞানই বাইরের বস্তুর আকারে প্রতিভাত হয়। এই যে সম্মুখে একটি ফুল গাছ আছে, অনাদি সংস্কারবশত এটির একটি আকার চেতনায় বর্তমান আছে । নীল, পীত প্রভৃতি ধারণা চেতনার স্বগত বাসনা বা আকার বিশেষ। যোগাচারগণ বলেন, চিত্ত বা মনই একমাত্র সৎ বস্তু। বাহ্যবস্তু বলে কোন কিছুরই সত্তা নেই। তাঁদের মতে চিত্ত বা
মন বলতে চিন্তা, ধারণা ও অনুভূতির প্রবাহকেই বুঝায়। তাঁরা বলেন, চেতনার বহির্ভূত বাহ্যবস্তু মনের ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনকি মানুষের দেহও তার চিত্ত বা মনের ধারণা মাত্র। স্বপ্নে বা চিত্তের বিকার অবস্থায় মানুষ যেমন অবস্তুকে অস্তিত্বশীল বাহ্যবস্তু বলে ভুল করে, তেমনি সুস্থ অবস্থায় মানুষ মনের ধারণাকে বাহ্যবস্তু বলে দর্শন করে। আসলে বাহ্যবস্তু বলে কিছুই নেই এবং এর অস্তিত্বের কোন প্রমাণও নেই। যোগাচারগণের মতে চেতনা এবং চেতনার বস্তু অভিন্ন। ধর্মকীর্তি বলেন, নীলবর্ণ এবং নীলবর্ণের জ্ঞান অভিন্ন, কারণ এদের পৃথক অবস্থায় কখনো দেখা যায় না। চক্ষুপীড়াবশত এক চন্দ্রকে যেমন দুই চন্দ্র বলে মনে হয়, তেমনি এরা অভিন্ন হলেও ভ্রমবশতঃ এদের পৃথক বলে মনে হয়। জ্ঞানের বিষয় ব্যক্তি- জ্ঞাতার মনের ভাব বা ধারণা ছাড়া অন্য কিছু নয়। যোগাচারগণ এই মত পোষণ করেন বলে তাঁদের মতবাদকে আত্মগত ভাববাদ (Subjective Idealism) বলা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যোগাচার সম্প্রদায়ের বিজ্ঞানবাদ অনুসারে একমাত্র বিজ্ঞান বা চৈতন্যই সত্য। তাইতো বিজ্ঞানবাদ মানুষের চৈতন্য সম্পর্কে যেসকল ব্যাখ্যা প্রদান করেছে তা সমগ্র ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারায় এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a7%8c%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%a7-%e0%a6%a6%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%b6/
admin

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!