বৌদ্ধ দর্শনে প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ বলতে কী বুঝ?
অথবা, বৌদ্ধ দর্শনে শর্তাধীন সৃষ্টিবাদ বলতে কী বুঝ?
অথবা, বৌদ্ধ দর্শনে প্রতীত্ব সমুৎপাদবাদ কী?
অথবা, প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : গৌতম বুদ্ধের (খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দ) বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠে সে মতবাদকে ‘বৌদ্ধ দর্শন’ বা ‘বৌদ্ধ ধর্ম’ বলে। গৌতম বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষার মূলে চারটি দার্শনিক তত্ত্ব রয়েছে। এ চারটি তত্ত্ব হলো প্রতীত্য সমুৎপাদ বা শর্তাধীন সৃষ্টিবাদ, কর্মবাদ, সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদ বা অনিত্যবাদ এবং অনাত্মবাদ। নিম্নে প্রশ্নপত্রের আলোকে বৌদ্ধ দর্শনের প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ বা শর্তাধীন সৃষ্টিবাদ আলোচনা করা হলো :
বৌদ্ধ দর্শনে প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ বা শর্তহীন সৃষ্টিবাদ : প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ কথাটি উদ্ভব হয়েছে ‘সমুৎপাদ’ ‘প্রতীত্য’ এবং শব্দ থেকে। ‘প্রতীত্য”- অর্থ হচ্ছে ‘প্রাপ্ত হয়ে’ এবং ‘সমুৎপাদ’ অর্থ ‘উদ্ভব’ বা ‘উৎপত্তি’। কাজেই ‘প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ’ কথাটির অর্থ কোন কিছুকে প্রাপ্ত হয়ে বা অবলম্বন করে অন্য একটি বস্তুর উদ্ভব। অর্থাৎ কারণকে প্রাপ্ত হয়ে কার্যের উৎপত্তি। যা কিছু ঘটে তা কোন পূর্ববর্তী কারণের উপর নির্ভর করেই ঘটে। অর্থাৎ কোন ঘটনা পূর্ববর্তী ঘটনা থেকেই সমুৎপন্ন হয়। বুদ্ধদেবের মতে, এ জগতে বিনা কারণে বা আকস্মিকভাবে কিছু ঘটতে পারে না। কিছু ঘটে তা কোন না কোন কারণের উপর নির্ভর করেই ঘটে। এ কার্য-কারণ সম্বন্ধ একটা সার্বিক ও অবশ্য স্বীকার্য নিয়ম। বুদ্ধদেবের মতে, এ নিয়ম স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ জগতের মধ্যে কাজ করে চলেছে। কোন ঈশ্বর বা অতীন্দ্রিয় চেতনসত্তা জগতকে পরিচালনা করে না। এ কার্যকরণ নিয়মকেই প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ (Theory of dependent origination) বলা হয়। প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ নীতিটিই হলো বৌদ্ধ দর্শনের অপর তিনটি দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তি। কর্মবাদ প্রতীত্য সমুৎপাদবাদের উপর নির্ভরশীল। কারণ অতীত কর্মের সংস্কারের ফলশ্রুতি হলো ব্যক্তির বর্তমান জীবন এবং এটাই তার ভবিষ্যৎ জীবনকে গঠিত করবে। ক্ষণিকত্ববাদ বা অনিত্যবাদও প্রতীত্য সমুৎপাদবাদের উপর নির্ভরশীল। যেহেতু বস্তু তার কারণের উপর নির্ভর করে, সেহেতু বস্তু আপেক্ষিক, পরনির্ভর শর্তাধীন এবং সীমিত। সুতরাং তারা ক্ষণিক হতে বাধ্য। অপরপক্ষে অনাত্মবাদ বা নৈরাত্ম্যবাদও প্রতীত্য সমুৎপাদবাদের উপর নির্ভরশীল। সবই যদি ক্ষণিক হয় তাহলে আত্মাও ‘ক্ষণিক এবং আপেক্ষিকও মিথ্যা। জড় দ্রব্যের অস্তিত্বহীনতা অর্থাৎ সংঘাত ও প্রতীত্য সমুৎপাদবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। কাজেই প্রতীত্য সমুৎপাদবাদের উপর অন্যান্য দার্শনিকতত্ত্ব নির্ভরশীল।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ বৌদ্ধ দর্শনের মূল দার্শনিক ভিত্তি। প্রতীত্য সমুৎপাদবাদনীতি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সকলের উপর প্রযোজ্য। এর কোন আরম্ভ বা শেষ নেই। দৈহিক বা মানসিক, সব রকম সংস্কৃতি ও ধর্মের ক্ষেত্রে এ নীতি প্রযোজ্য ।