বৌদ্ধদর্শনে বৈভাষিক সম্প্রদায়ের বাহ্যপ্রত্যক্ষবাদ আলোচনা কর।
অথবা, বৈভাষিক সম্প্রদায়ের বাহ্য প্রত্যক্ষবাদ আলোচনা কর।
অথবা, বৌদ্ধদর্শনে বৈভাষিক সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্ব আলোচনা কর ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতীয় দর্শনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে বৌদ্ধদর্শন। বুদ্ধদেব জীবিত থাকাকালীন তাঁর শিষ্যবর্গ তাঁর নির্দেশ অনুসারে দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর যখন তাঁর কর্ম দিকে দিকে এবং দেশে দেশে প্রচারিত হতে লাগল তখন বুদ্ধদেবের ধর্মমতকে নানা . সমালোচনার সম্মুখীন হতে হলো। ফলে প্রতিপক্ষের অভিযোগ খণ্ডন করার জন্য তার শিষ্যবর্গ বৌদ্ধদর্শনের বিভিন্ন দিকগুলোর পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় নিজেদের নিয়োজিত করলেন। বৌদ্ধদর্শনে যেসব সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটেছে তাদের মধ্যে বৈভাষিক সম্প্রদায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বৈভাষিক সম্প্রদায় : সম্রাট কণিঙ্কের রাজত্বকালে ‘অভিধম্ম’ গ্রন্থের ‘বিভাষা’ নামে একটি ভাষ্য রচিত হয়েছিল। এই বিভাষা ভাষ্যের অনুগামীদের ‘বৈভাষিক’ নামে অভিহিত করা হয়। বৈভাষিকগণ ‘সুত্ত’কে প্রামাণ্য মনে করেন না। তাঁদের মতে, ‘অভিধম্মই’ একমাত্র প্রামাণ্য। বৈভাষিকগণ হীনযান ধর্ম সম্প্রদায়ভুক্ত।
বৈভাষিক সম্প্রদায়ের বাহ্যপ্রত্যক্ষবাদ : সৌত্রান্তিকদের মতো বৈভাষিকগণও সর্বাস্তিবাদী এবং মন ও বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করেন। বৈভাষিকগণ বাহ্যবস্তুকে প্রত্যক্ষণগ্রাহ্য বলে স্বীকার করেন। কিন্তু সৌত্রান্তিকদের মতে বাহ্যবস্তু অনুমানসিদ্ধ । বৈভাষিকগণ বলেন, প্রত্যক্ষ করা ছাড়া আর কোন প্রমাণের সাহায্যে বাহ্যবস্তুর অস্তিত্বকে জানা যায় না। সৌত্রান্তিকগণের বিরুদ্ধে তাঁরা বলেন, বাহ্যবস্তু অনুমানসিদ্ধ নয়। তাঁদের মতে, অনুমানের একটি বিখ্যাত উদাহরণ, ধূম দেখিয়া আমরা আগুনের অস্তিত্ব অনুমান করি। পূর্বে ধূম ও অগ্নির সম্বন্ধ প্রত্যক্ষ করি বলেই এই অনুমান সম্ভব হয়। কোন ব্যক্তি যদি কোন দিন আগুন প্রত্যক্ষ করে না থাকে তবে তার পক্ষে ধূম দেখে আগুন অনুমান করা সম্ভব নয়। সুতরাং বাহ্যবস্তুর অস্তিত্বও অনুমান করা যায় না, যদি কোন দিন বাহ্যবস্তুকে সাক্ষাৎভাবে প্রত্যক্ষ করা না হয়। সৌত্রান্তিকদের মতে কোন বাহ্যবস্তু সম্পর্কে মনের যে ধারণা তাকে আমরা সাক্ষাৎভাবে জানি এবং সেই ধারণা হতে বস্তুর অস্তিত্বকে অনুমান করি। কিন্তু ঐ বস্তুকে যদি সাক্ষাৎভাবে না জানি, তবে ধারণাটি যে ঐ বস্তুর অনুলিপি বা প্রতীক তা বুঝবো কেমন করে? সুতরাং হয় আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় যে, আমরা ধারণা ছাড়া কিছুই জানতে পারি না (বিজ্ঞানবাদ), না হয় স্বীকার করে নিতে হবে যে বাহ্যবস্তুর নিজস্ব সত্তা আছে এবং তাকে সাক্ষাৎভাবে জানা যায়। কিন্তু
বিজ্ঞানবাদ অর্থাৎ আমরা ধারণা ছাড়া কিছুই জানতে পারি না, এটি ভ্রান্ত মতবাদ। সুতরাং বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব আছে এবং তার অস্তিত্বকে সাক্ষাৎভাবে জানা যায় তা মেনে নিতে হয়। এ কারণেই বৈভাষিকদের মতবাদকে বাহ্যপ্রত্যক্ষবাদ বলে। বৈভাষিকগণ বিজ্ঞানবাদ ও বাহ্যানুমেয়বাদ উভয়কে খণ্ডন করে নিজেদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাহ্যপ্রত্যক্ষবাদের সঙ্গে পাশ্চাত্য নব্য-বাস্তববাদীদের মতবাদের মিল দেখা যায়। বৈভাষিক দর্শন অনুসারে জড়বস্তু এবং আত্মা কতকগুলো ক্ষণিক উপাদানের সমষ্টি। উপাদানকে এ দর্শনের পরিভাষায় ‘ধর্ম’ বলা হয়। সমস্ত অবয়বী বস্তু কতকগুলো ক্ষণস্থায়ী ধর্মের মিলনে উৎপন্ন হয়। ধর্ম বা উপাদান তিন প্রকার; যথা : রূপ, আয়তন এবং ধাতু । পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং মনকে একসঙ্গে ষড়ায়তন বলে। দেহ-মন পঞ্চস্কন্ধের মিলনে সৃষ্টি হয়। প্রত্যেকটি উপাদান আবার অসংখ্য আত্যন্তিক উপাদান বা ধাতুর সংমিশ্রণে উৎপন্ন হয় বলে উপাদানকে ধর্ম-স্কন্ধ বলে। আত্মাকে বিজ্ঞান-স
্কন্ধ বলে। নানা চৈতন্যবৃত্তি এবং সংস্কারের যৌথ কার্যের ফলে আত্মার উপলব্ধি হয় । বৈভাষিক দর্শন হীনযান সম্প্রদায়ের দেহ-মন সম্পর্কিত ব্যাখ্যা, প্রতীত্য সমুৎপাদ তত্ত্ব, দ্বাদশ নিদান, আর্যসত্যচতুষ্টয় এবং ক্ষণিকতাবাদ সমর্থন করে। বৈভাষিক মতে বাহ্যবস্তুমাত্রেই আপেক্ষিক কার্যকারণের অধীন। একটি উপাদানকে আশ্রয় করে অপর একটি উপাদানের উৎপত্তি হয়। অব্যবহিত পূর্ববর্তী কারণটিকে সমনন্তর প্রত্যয় বলা হয়। যে প্রত্যয়টি আশ্রয় করে অপর একটি প্রত্যয়ের সৃষ্ট হয় তাকে অধিপতি প্রত্যয় বলে। অধিপতি প্রত্যয় না ঘটলে নির্দিষ্ট কার্য উৎপন্ন হতে পারে না। বস্তুর রূপ, রস, গন্ধ, শব্দের সংবেদন এবং প্রত্যক্ষ হয়। বাহ্যবস্তু এবং এর গুণসমূহকে আশ্রয় করে সংবেদন এবং প্রত্যক্ষের সৃষ্টি হয়
লে এদেরকে আলম্বন প্রত্যয় বলে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, বৈভাষিক সম্প্রদায়ের বাহ্যপ্রত্যক্ষণবাদ অনুসারে বাহ্যবস্তুর নিজস্ব সত্তা আছে। তাইতো বৈভাষিক সম্প্রদায়ের বাহ্যপ্রত্যক্ষণবাদ বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে যেসব ব্যাখ্যা প্রদান করে তা সমগ্র ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারায় এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।