বৈষ্ণবতত্ত্বের বিষয়বস্তু আলোচনা কর।

অথবা, বৈষ্ণবতত্ত্ব কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করে?
অথবা, বৈষ্ণবতত্ত্বের পরিধি আলোচনা কর।
অথবা, বৈষ্ণবতত্ত্বের পরিসর বর্ণনা কর।
অথবা, বৈষ্ণবতত্ত্বের বিষয়বস্তু বা পরিধি ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মধ্যযুগের বাংলার আধ্যাত্মবাদের উষর ভূমিতে যে কয়টি দার্শনিক ও ধর্মীয় মতধারা উদ্ভব ও
বিকাশ লাভ করে বাঙালির চিন্তা- চেতনা ও জীবনাদর্শে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সম্মত হয় তন্মধ্যে বৈষ্ণববাদ অন্যতম প্রধান।
বৈষ্ণব ধর্মমতের সার বা নিগূঢ় তত্ত্বকথা নিয়েই গড়ে উঠেছে বৈষ্ণব দর্শন বা বৈষ্ণববাদ । রাধাকৃষ্ণের প্রেমই বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের মূল নির্যাস। রাধাকৃষ্ণের পরকীয়া প্রেমের অন্তরালেই বৈষ্ণব দর্শনের যাবতীয় তাত্ত্বিক বিষয়সমূহ ব্যাখ্যাত হয়েছে।
বৈষ্ণবতত্ত্বের বিষয়বস্তু : রাধাকৃষ্ণ এবং রাধাকৃষ্ণকে আশ্রয় করে প্রেমভক্তি ও তদ্‌সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহকে নিয়েই গড়ে উঠেছে বৈষ্ণবতত্ত্বের বিষয়বস্তু। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. রাধাকৃষ্ণ : রাধাকৃষ্ণ বৈষ্ণবতত্ত্বের মূল বিষয়বস্তু। বৈষ্ণবতত্ত্ব অনুসারে স্রষ্টার দুটি প্রকাশ বিদ্যমান। একটি প্রকাশ হলো স্বরূপ প্রকাশ এবং অপরটি প্রেমরূপ প্রকাশ। বৈষ্ণব মতে, কৃষ্ণ পরম স্রষ্টা, আর রাধা সৃষ্টির প্রতীক। পরমসত্তা কৃষ্ণ নির্গুণ ব্রহ্ম নন বরং এমন এক পরম পুরুষ যিনি ভক্তের পরম আত্মীয় ভক্তের ভগবান। পরমসত্তা, কৃষ্ণ ভেদবুদ্ধি বা জ্ঞানের বস্তু নয় বরং পরম উপন্যাস ও প্রেমের বস্তু । আদিতে তিনি এক ছিলেন। কিন্তু জীবলীলা সদ্ভোগের জন্য তিনি সৃষ্টিকে নিজ থেকে পৃথক করে পরিণত হলেন বন্ধুতে, কেননা প্রেমাস্পদ ছাড়া প্রেম হয় না। এ কারণেই সত্তা সৃষ্টি থেকে পৃথক হলেন।
আর তাই সৃষ্টি ও স্রষ্টা, রাধা ও কৃষ্ণ দুই হয়েও প্রেমে আবদ্ধ বা দুইয়ে মিলে এক। পরম পুরুষ কৃষ্ণ নিজ দেহে রাধা ভাব অনুভব করেন। আবার রাধাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কৃষ্ণ বেদনা বিধুর থাকেন। এভাবে কৃষ্ণ সৃষ্টি লীলাসহ নানা লীলা করে থাকেন।
২. প্রেমভক্তি: বৈষ্ণবতত্ত্ব বা দর্শনের মূলকথা প্রেমভক্তি। বৈষ্ণবরা ঈশ্বরের মধুর রূপ ও রসময়তা অবগাহনের জন্য প্রেম বা ভক্তিবাদের উপরই বেশি জোর দিয়ে থাকেন। তবে বৈষ্ণবরা কোনো সাধারণ প্রেম নয় দেহের মধ্য দিয়ে বিকশিত দোহাত্তীর্ণ অতীন্দ্ৰিয় প্রেম বা ঈশ্বর ‘প্রেমেরই আরাধনা করেন। তাঁদের মতে, শ্রীকৃষ্ণ একমাত্র ঈশ্বর ও আরাধ্য; কিন্তু তিনি প্রেমময়। তাঁকে লাভ করতে হয় প্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। তাই প্রেমই বৈষ্ণবের সাধনা, প্রেমই বৈষ্ণবের ধ্যানজ্ঞান। এ প্রেম মামুলি বা পার্থিব নয় বরং ঐশ্বী প্রেম। পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করার, তাঁর সাথে মিলিত হবার প্রেম। এ. প্রেমে জাতি, ধর্ম, কূল, শ্রেণির কোন ভেদাভেদ নাই। তাইতো বৈষ্ণব দর্শনতত্ত্বের মূলকথা জাতি নয়, শ্রেণি নয়, কূল নয়, ভক্তি ও প্রেমই মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয়, প্রেমই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
৩. ঈশ্বর : ঈশ্বর বৈষ্ণবতত্ত্বের অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু। বৈষ্ণব মতে, মানবসত্তা জ্ঞান, কর্ম, প্রেম এ তিনটি বৃত্তি নিয়ে গঠিত। অভাব বা প্রয়োজন থেকে কর্মের সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু পরমসত্তা ঈশ্বর পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাঁর কোনো প্রয়োজন বা অভাববোধ নেই বিধায় এ পথে ঈশ্বর প্রাপ্তির আশা বৃথা। আবার পরমার্থিক জ্ঞান সাধারণ মানুষের সত্যাতীত
বলে সব মানুষের পক্ষে জ্ঞানের পথে পরমার্থিক সত্তা তথা ঈশ্বরের সন্ধান প্রাপ্তি সম্ভব নয়। তাই বৈষ্ণব মতে, জ্ঞানে নয়
কর্মে নয়, প্রেমভক্তির মাধ্যমেই কেবল সসীম মানুষের পক্ষে পরমসত্তা ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব। ঈশ্বরের ধারণা ব্যাখ্যায় বৈষ্ণব মতের বক্তব্য হলো পরমতত্ত্ব হচ্ছে হরি বা কৃষ্ণ, তিনি ভগবান, পরম ঐশ্বর্যবান। তাঁর ঐশ্বর্যসমূহের সংখ্যা হয় এবং এগুলো হলো পূর্ণ সৌন্দর্য, পূর্ণ ঐশ্বর্য, পূর্ণ বীর্য, পূর্ণ যশ, পূর্ণ জ্ঞান এবং পূর্ণ বৈরাগ্য। এই ছয়টি ঐশ্বর্য অনন্ত। পরমতত্ত্ব স্বগুণ, তিনি নির্গুণ নয়। তাঁর এ ছয়টি অনন্ত গুণের মধ্যে সৌন্দর্য হলো সর্বপ্রধান। এ জগতে ঈশ্বরের ত্রিবিধ
শক্তি ক্রিয়াশীল যথা- চিৎশক্তি, জীবশক্তি ও মায়া শক্তি, চিৎশক্তির বলে ঈশ্বর জগতে প্রকাশমান এবং প্রজ্ঞাবান, জীবশক্তি
বলে ঈশ্বর জগতে অসংখ্য শান্ত জীব সৃষ্টি এতে লীন থাকেন এবং মায়াশক্তি বলে তিনি জড়জগৎ সৃষ্টি করে এতে অন্তরীণ আছেন। এ ত্রিবিধ শক্তি বাস্তবিক পক্ষে এক অভিন্ন এবং যুগপৎ
৪. রাসতত্ত্ব : বৈষ্ণবতত্ত্বের অন্যতম আলোচ্যবিষয় হলো রসতত্ত্ব। প্রাচীন সংস্কৃত রসশাস্ত্রে রতি, হ্রাস, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, জুগুপ্সা, বিস্ময় এবং শম এ নয়টি ভাব এবং এদের অনুরূপ শৃঙ্গার। হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভূত এবং শান্ত এ নয়টি রসের উল্লেখ আছে। বৈষ্ণব মতে, এ নয়টি ভাবের মধ্যে রতিভাব শ্রেষ্ঠ এবং রসের
মধ্যে ‘শৃঙ্গার রস’ শ্রেষ্ঠ। বৈষ্ণব ভক্তের কাছে সর্বপ্রিয় বস্তু হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাই তাঁদের রতি হলো কৃষ্ণ রতি, তাঁর রস রূপ (ভাব) হলো প্রেমভক্তি রস। বৈষ্ণবতত্ত্বে রতিভাব পাঁচ ভাগে বিভক্ত। যথা: শান্তরতি, দাস্যরতি, সখ্যরতি,
বাৎসল্যরতি ও মধুর রতি। আবার কৃষ্ণভক্তি রসও পাঁচ প্রকারের, যথা : শান্তরস, দাস্য-রূপরস, সখ্যরস, বাৎসল্য রস ও
মধুর রস। মধুরা রতির আবার তিনটি স্তরভেদ আছে, যথা: সাধারণী, সামঞ্জস্যা ও সমর্থ।
৫. মানবতা : মানবিক বিষয়াদির প্রতি আগ্রহ ও মনুষ্য কল্যাণকর নীতিজাত দৃষ্টিভঙ্গি তথা মানবতাবাদও বৈষ্ণবতত্ত্বের অন্যতম বিষয়বস্তু। বাঙালির চিন্তাধারায় চর্যাপদকে কেন্দ্র করে যে মানবতাবাদী আদর্শের স্ফুরণ ঘটে তাই ক্রমবিকশিত হয়ে মধ্যযুগের বৈষ্ণবতত্ত্বে এসে পূর্ণতা লাভ করে। বৈষ্ণবতত্ত্বের মূল কথা প্রেম, ঈশ্বর প্রেম হলেও তা মানবপ্রেম বর্জিত নয়, বরং মানবতা বা মানবপ্রেমই হচ্ছে এ মতের ঈশ্বর প্রেমের সোপান। বৈষ্ণবরা মনে করেন ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ সব মানুষ, সব জীবে বর্তমান। তাই মানুষের সেবা আর ভগবান সেবা একই কথা। মানুষকে সেবা করলেই ভগবানকে পাওয়া যায় আবার বিপরীতক্রমে ভগবানের সেবা করাই হলো মানুষের সেবা করা। কেননা সকল মানুষ সকল জীবে ঈশ্বর বিরাজমান। এ কারণেই বৈষ্ণবদর্শনে কৃষ্ণ নাম জপকীর্তনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবন মননের মান
উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়।
৬. অচিন্ত্যভেদাভেদ : রাধাকৃষ্ণের প্রেমই বৈষ্ণবধর্ম ও দর্শনের মূল নির্যাস। কৃষ্ণ স্রষ্টা, আর রাধা সৃষ্টির প্রতীক। রাধা ও কৃষ্ণ নিবিড় প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ। কিন্তু স্রষ্টা ও সৃষ্টি, রাধা ও কৃষ্ণের এ যে সম্বন্ধ তা কি ভেদ-বিভেদের
অভেদ অভিন্নতার সম্বন্ধ? এ প্রশ্নে বৈষ্ণব তত্ত্বে যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তাই অচিন্ত্যভেদাভেদতত্ত্ব নামে পরিচিত। বৈষ্ণব
সম্বন্ধ, না তত্ত্বানুসারে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে যে সম্বন্ধ তা নিছক ভেদের সম্বন্ধ নয়। কারণ, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে ভেদ ও অভেদ দুই-ই যুগপৎ বিদ্যমান। সৃষ্টি ও স্রষ্টা, রাধা ও কৃষ্ণ বিভিন্ন হয়েও অভিন্ন, দুই হয়েও একাত্ম। তাইতো, বৈষ্ণব বলে- “সদ্যপি রাধাকৃষ্ণ সর্বদা অভিন্ন
তথাপি লীলার লাগি যুগপদ্ধিভিন্ন।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, মূলত রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করেই বৈষ্ণবতত্ত্বের বিষয়বস্তু সূচিত ও ক্রমবিকশিত । রাধাকৃষ্ণের পরকীয়া প্রেমের প্রতীকেই কালচরিত হয়েছে বৈষ্ণবতত্ত্বের বিষয়বস্তু।