
ডিগ্রী অনার্স মাস্টার্স পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে পেতে Whatsapp এ ম্যাসেজ করুন। Whatsapp 01979786079
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা কর ।
admin
- 0
অথবা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য ব্যাখা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এক অন্যান্য মহিমামণ্ডিত অধ্যায়। ভাষা আন্দোলন হতেই বাঙালি জাতি অধিকার সচেতন হয়ে উঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ভাষা আন্দোলন। আর ভাষা আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা বা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয় তা মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা বা তাৎপর্য : পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের কুচক্রী সরকার বাংলা ভাষার উপর সর্বপ্রথম আঘাত হানে। তারা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু পূর্ব বাংলার ছাত্রজনতা মাতৃভাষা বাংলা রক্ষায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে নিহত হয় রফিক, শফিক, জব্বারসহ নাম না-জানা অসংখ্য ছাত্র জনতা। ভাষাপ্রেমিক নাগরিক পাকিস্তান সরকারের এ ষড়যন্ত্রকে রুখে দেয়। এ আন্দোলনই ভাষা আন্দোলন। নিচে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
১. স্বতন্ত্র অস্তিত্ব : বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা অপরিসীম। বাঙালি জাতি যে একটি স্বতন্ত্র জাতি, তাদের নিজস্ব আচার, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও ভাষা রয়েছে। এ স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয় প্রথম ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে অর্থাৎ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে।
২. আত্মসচেতনাবোধ জাগ্রত : বাঙালি জাতির আত্মসচেতনতাবোধ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলন ছিল মূল প্রেরণা। ভাষা আন্দোলনের প্রকৃতি থেকে বাঙালিরা বুঝতে শিখে যে, তাদের নিজস্ব স্বার্থ, নিজস্ব চেতনা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদের আত্মসচেতনতাবোধ জাগ্রত করে।
৩. জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি : ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার সমগ্র জনতা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলে। পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। এ ঐক্যবদ্ধতা পরবর্তী আন্দোলনগুলোতে মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
৪. মুক্তির দাবি : ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে চেতনাবোধ জাগ্রত হয় তার উপর ভিত্তি করে বাঙালিরা
মুক্তির স্বপ্ন দেখতে থাকে। পাকিস্তান সরকারের নিপীড়ন, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে, যার মূল প্রেরণা ছিল ভাষা আন্দোলন।
৫. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৃষ্টি : ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে তার ফলে পূর্ব বাংলার হিন্দু মুসলিম একত্রিত হয় এবং পাকিস্তান সরকারবিরোধী আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে আন্দোলন করে, যা পূর্ব বাংলার হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি।
৬. রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব : ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে তার পিছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ছাত্র, ব্যবসায়ী প্রভৃতি পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল। এরা একটি নতুন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করে পরবর্তী আন্দোলনগুলোতে। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক অংশগ্রহণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ় হয়।
৭. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সৃষ্টি : ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব ব
াংলার জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চিন্তা ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। বাংলা ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষার দাবি ও অধিকার উপেক্ষা করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। দাবি উত্থাপন, দাবি আদায় ও গণসম্পৃক্ত আন্দোলন করার মূল প্রেরণা ছিল ভাষা আন্দোলন।
৮. ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সূচনা : ভাষা আন্দোলনের চেতনা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সূচনা করে। দাবি আদায়ের জন্য প্রয়োজন ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের বিজয় বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সূচনা করে যা পরবর্তীতে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলা এবং ‘৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, সর্বশেষ স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত ঐক্যবদ্ধতা।
৯. দাবি আদায়ে উদ্বুদ্ধ : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতি দাবি আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয় তা সকল বাঙালিদের একটি প্লাটফর্মে দাঁড় করায়। ফলে শোষণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদী হয় এবং দাবি আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়।
১০. রাজনৈতিক আন্দোলনে ছাত্রদের গুরুত্ব বৃদ্ধি : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছাত্রদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রসমাজ বিজয়ী হয়। ফলে পরবর্তী সকল গণআন্দোলনে ছাত্ররা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং গণআন্দোলনকে গতিশীল করে দাবি আদায়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়।
১১. একুশের চেতনা : একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির আত্মত্যাগের ফলে সংগ্রামী চেতনা লাভ করে, যা অন্যান্য আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে স্বদেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে যা স্বাধিকার আদায়ে অগ্রসর হয়।
১২. স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতির মধ্যে যে বাঙালি জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয় তা স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল অনুপ্রেরণা ছিল। ভাষা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়েই বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জনের চুড়ান্ত সংগ্রামে লিপ্ত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালির জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে তা বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রামকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ফলে যে স্বাধীনতার বীজ বপিত হয় তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কাজেই ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি।