বাউল দর্শনের মানবতাবাদী চিন্তাধারা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউলবাদের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউল মানবতাবাদ সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, বাউল দর্শনের মানবতাবাদ সম্পর্কে যা জান লেখ।
উত্তর।৷ ভূমিকা : মধ্যযুগীয় বাংলায় বর্ণবাদের কষাঘাতে দ্বিধাবিভক্ত সমাজ কাঠামোতে নিম্নবর্ণের নির্যাতিত ও শোষিত বঞ্চিত সাধারণ মানুষের মুক্তি তথা মানুষ ও মানবতার অমর বাণী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল বাঙালির নিজস্ব মননের ফসল বাউল ধর্ম ও দর্শন। সুফিবাদের প্রভাবে এগারো শতক থেকে বাংলার সমাজকাঠামোতে মানবতাবাদের যে বিকাশধারা সূচিত হয় তার পূর্ণাঙ্গ স্ফুরণ ঘটে বাউল দর্শনে। বাউলরা মানুষ এবং মানবতাকেই তাঁদের সমগ্র সাধন ক্রিয়ার কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করে। তাই দেখা যায় সমাজের উচ্চবর্ণের বিলাসী সুবিধাভোগী শ্রেণি নয় বরং নিম্নবর্ণের শোষিত বঞ্চিত সাধারণ মানুষই বাউল ধর্মকে আঁকড়ে ধরেছিল। মানবতার আকর্ষণে বাউল ধর্ম ও দর্শনের এ মানবতাবাদী দিকটিকে তুলে ধরতে গিয়ে একজন পণ্ডিত যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “সমাজের উপরতলার লোকের ধর্ম হলে এ মতবাদ যে কেবল বাঙালির জীবন ও ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতো তা নয় দুনিয়ার মানুষের কাছে উদার মানবিকতার জন্য বাঙালিকে শ্রদ্ধেয় করে তুলতো।”
বাউল মানবতাবাদ : ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’- মানবতাবাদের এই অমর বাণীর উৎকৃষ্টতম তথা চরম ও পরম বিকাশ ঘটেছে বাউলদের চিন্তাভাবনায়। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ জ্ঞান করা বাউলরা মানে না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে ঐক্য, সাম্য ও প্রেমের বাণীই বাউলরা প্রচার করে তাঁদের গানে ও সাধন ক্রিয়ায়। বাউলদের এই মানবতাবাদী চিন্তারই পূর্ণাঙ্গ বিকাশ আমরা দেখতে পাই তাদের শাস্ত্র বিমুখতায় গুরুবাদে এবং চারচন্দ্রভেদ সাধনায়। বাউলদের মতে, শাস্ত্রের চেয়ে সত্য বড়; আচার অনুষ্ঠান ও বিধিবিধানের চেয়ে মানুষ বড়। তাঁদের নিকট তত্ত্বের জন্য মানুষ নয় এমনকি তাঁরা আরো এগিয়ে গিয়ে বলেন যে মানুষের জন্যও তত্ত্ব নয়। মানুষ কোনো তত্ত্ব বা শাস্ত্রের অধীনে নয়।শাস্ত্র কখনো মানুষের উপরে স্থান পেতে পারে না। শাস্ত্র মানা যেমন মানুষের উচিত নয়। তেমনি শাস্ত্র প্রণয়ন করাও মানুষের কাজ নয়। মানুষ সাধনার মাধ্যমে নিজকে জানবে এবং এই নিজকে জানা ও উপলব্ধির মাধ্যমে প্রকৃত আত্মার সন্ধান পাবে।তাই বাউলদের কাছে শাস্ত্র বা তত্ত্ব নয় মানুষই সবচেয়ে বড়, সাধনার দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষই স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, মানুষেই স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ । বাউলরা তাই মানুষকে সকলের উপর স্থান দেন, মানুষকে আশ্রয় করে তাঁরা সাধনা করেন।বাউল গুরুবাদানুসারে মানুষই মানুষকে পথ দেখাতে পারে। এর জন্য কোনো অতীন্দ্রিয় সত্তার প্রয়োজন নেই। তাই বাউলরা মানব গুরুরই দ্বারস্থ হন। তাঁরা গুরুকে দুইভাবে কল্পনা করেন- মানুষরূপে এবং মানুষরূপী স্বয়ং ঈশ্বররূপে, গুরু বা মুর্শিদ যে এ জগতে পরম সম্পদ এবং ঈশ্বর স্বয়ং যে গুরুরূপে শিষ্যকে সাধন পথে পরিচালিত করেন বাউলদের তেমনই বিশ্বাস। তাঁদের এই ঈশ্বর বেদের ঈশ্বর নন বা মানুষ বহির্ভূত কোনো সত্তা নন। মানুষই সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরত্ব লাভ করে। গুরুরূপে অন্যদের শিষ্যত্ব প্রদান করে সিদ্ধির পথ দেখানো। তাইতো বাউল সম্রাট লালন বলেন, “মানুষ গুরু কল্পতরুভজ মন, মানুষ হয়ে মানুষ ভজ পাবা মানুষে মানুষ রতন।”
বাউল মানবতাবাদের পূর্ণবিকাশ পরিলক্ষিত হয় তাঁদের চারচন্দ্রভেদ সাধনার গূঢ় তত্ত্বে। এ তত্ত্ব মতে, মানুষ এমন এক সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি যে তার কোনো অংশই ঘৃণার বিষয় নয়। চারটি চন্দ্র একের পর এক ভেদ করার সাধনায় বাউল সাধক সার্থক হয়ে এই তথ্যটিই প্রমাণ করে দেয়, মানবদেহ অতি পবিত্র এবং দেহই পরমাত্মার মন্দির ও মসজিদ। এ দেহের সাধনার মাধ্যমেই পরমাত্মার সন্ধান পাওয়া যায়। যদিও নর নারীর পিণ্ডদেহকে পকু দেহে পরিণত করে সীমার মারফতে অসীম প্রেমরস উপলব্ধি -এটি তাঁদের মূল লক্ষ্য। “কিন্তু তা মূল লক্ষ্য হলেও সহজিয়া মানুষকে ভুলতে পারে না। বস্তুত বাস্তব মানুষই তাঁদের প্রেম সাধনার মূল উপাদান।”
মানুষে মানুষে কিংবা ধর্ম ও সম্প্রদায়গত ভেদ বাউলরা মানে না। হিন্দু-মুসলমান সকলের জন্যই বাউলের দ্বার উন্মুক্ত। মুসলমান ফকির, রসিক বৈষ্ণব, বৌদ্ধ সহজিয়া ও হিন্দু বাউল সবার জন্য একই তত্ত্ব একই সাধন পদ্ধতি।সবচেয়ে বড় কথা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ একই বিশ্বমানবতার অন্তর্ভুক্ত এটাই বাউলদের বিশ্বাস । বাউলরা তাই গায় :
“নানা বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ
জগৎ ভরমিয়া দেখিলাম একই মায়ের পুত।”
দুনিয়ার সব মানুষ যে সমান, সার্বজনীন ঐক্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব যে সব ধর্মের মূল শিক্ষা, সব অধ্যাত্মতত্ত্ব ও যথার্থ দর্শনের লক্ষ্যও যে এক ও অভিন্ন তারই অভ্রান্ত ইঙ্গিত নিহিত বাউলদের উচ্চারিত এই দুটি লাইনে।
উপসংহার : সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ ও মানবতার চর্চাই বাউলদের সাধনা, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে অন্তরে ধারণ করেই বাউলের পথচলা, এ মানবতাবাদী আদর্শের ধারক বলেই বাউলরা পরমতসহিষ্ণু। অসাম্প্রদায়িক ব্যাপক মনের অধিকারী, উদার ও সদাশয়।