বাউল দর্শনের মনের মানুষ তত্ত্ব আলোচনা কর।
অথবা, মনের মানুষ তত্ত্ব কী?
অথবা, মনের মানুষ তত্ত্বটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মনের মানুষ তত্ত্বটি সম্পর্কে যা জান লেখ।
অথবা, বাউল দর্শনের আলোকে মনের মানুষ তত্ত্বটি তুলে ধর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : মধ্যযুগের বাঙালির নিজস্ব মননে বিকশিত দেহ সাধনভিত্তিক একটি মরমিবাদী চিন্তাধারা হচ্ছে বাউল দর্শন। বাউলদের সমগ্র চিন্তাধারা ও সাধন ক্রিয়ার মূলকেন্দ্র বা উৎস হচ্ছে দেহ তথা মানুষ। দেহকে কেন্দ্র করে তাঁদের এ আত্মিক বা আধ্যাত্মিক সাধনা মানবাত্মাকে কেন্দ্র করে পরমাত্মাকে জানার সাধনা। অর্থাৎ বাউলরা সাধক মনের মানুষ বা আত্মাতত্ত্বের সাধক। নিষ্ক্রিয়তা, জীবন বিমুখতা ও আত্ম সন্ধানের মাধ্যমে মনের মানুষ সন্ধানই বাউলদের প্রধান লক্ষ্য। তাই বাউল দর্শনে মনের মানুষ তত্ত্বের গুরুত্ব অত্যধিক।
মনের মানুষ তত্ত্ব : বাউলরা মানব দেহস্থিত আত্মারূপী পরমাত্মাকে ‘মনের মানুষ’ বলে অভিহিত করেন। তাঁরা এ মনের মানুষকেই খুঁজে বেড়ান মানবদেহের মধ্যে। কেননা তাঁরা বিশ্বাস করেন, দেহের সাধনার দ্বারাই এ মনের মানুষের দেখা পাওয়া যায়। তাঁদের আত্মাকে মানুষ ‘মনের মানুষ’ ‘মানুষ রতন’ ইত্যাদি বলার তাৎপর্য এ যে আত্মা মানবদেহকে অবলম্বন করে বাস করেও মানব আকার সাধনা দ্বারা এ তত্ত্ব লাভ করা যায়। তাই বাউলদের কাছে ‘মানুষ’ সবচেয়ে বড়। সাধনার দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষই স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষেই স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। তাই বাউলরা মানুষকে সকলের উপরে স্থান দেন। মানুষের দেহকে আশ্রয় করে সাধনা করেন। মানবের শাশ্বত জীবনই তাঁদের আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্র। এ দেহের মাঝেই তাঁরা আকাশ ও পৃথিবীকে কল্পনা করেন। এ দেহের মাঝেই তাঁরা স্রষ্টার শ্রেষ্ঠরূপ লক্ষ্য করেন। এ দেহের মধ্যেই পরম সুন্দর বা স্রষ্টার বাস এ তাঁদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেই তাঁরা দেহের সাধনায় লিপ্ত হন। অর্থাৎ বাউলরা পরম তত্ত্ব ‘সহজ’কে মানব হৃদয়ে অবস্থিত প্রেমাসম্পদ মানুষ রতন মনের মানুষরূপে বিচার করে ও তার সাথে প্রেম মিলন কামনা করে। হিন্দু বাউলরা এ দেহের মধ্যেই আত্মারূপী স্রষ্টা বা ভগবানকে খুঁজে পেতে চান। আবার এ স্রষ্টাকেই মুসলমান বাউল, ফকির, সুফি, দরবেশ, আউলিয়া সাধকরা নানাভাবে উপলব্ধি করেন। তাঁরা আল্লাহ বা স্রষ্টার একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্বকে মেনে নিয়েই এ বিশ্বের বিচিত্র সৌন্দর্যাবলির নানা বস্তু ও সত্তা পর্যালোচনা করে যেমন- সমগ্র বিশ্ব বৈচিত্র্যের মধ্যে তেমনি মানুষের মধ্যে মনের মানুষকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করেন। মুসলমান সুফি, দরবেশ, ফকির, সাধকদের বিশেষে করে লালনের গান বিশ্লেষণ করলেই বেশ বুঝা যায় তাঁরা মানুষের মধ্যে স্রষ্টার উপস্থিতি তথা মনের মানুষ উপলব্ধি করেন। মানুষের মধ্যে ‘মনের মানুষ’ লাভ করে মিলন সাধনার অভিপ্রায়ে লালন বলেন, মানুষ গুরু কল্পতরুভজ মন, মানুষ হয়ে মানুষ ভজ পাবা মানুষে মানুষ রতন। গুরুকে নাগর কর, নাগরী হবে দশ ইন্দ্রিয় অনুশিষ্য করতে পারবে। গুরু সেবা প্রসঙ্গ হলে তাতে মিলবে সিদ্ধ বস্তু ধন। লীলা তত্ত্ব, মিথুন তত্ত্ব, যত তত্ত্ব আছে, বিচারিলে উক্ত তত্ত্ব মিলবে তারই কাছে। অখণ্ড মানবদেহ, তাই লালন বলে, জেনে কর সাধনা, “লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে লালন শাহ এখানে সাধনার দ্বারা মানুষ তথা সাধকের ‘দশেন্দ্ৰিয়’ যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করে অখণ্ড মানবদেহের সাধনা করে মানুষের মধ্যে পরম তত্ত্ব তথা ‘মানুষ রতন’ বা ‘মনের ১ নুষ’ আবিষ্কার ও উপলব্ধির কথা বলছেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে বাউল ফকির আউলিয়া, দলবেশরা ‘মনের মানুষ’কে জেনে আত্মার মুক্তিতে বিশ্বাস করেন, আত্মমগ্ন হয়ে তাঁদের ‘মনের মানুষ’ সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ধ্যানের মাঝে খুঁজেন। এ ‘মনের মানুষ তত্ত্বই বাউল ধর্ম, দর্শন ও সাধনার মূলতত্ত্ব বা সারকথা।
উপসংহার : অতএব বলা যায়, বাউলদের সফল প্রকার দেহকেন্দ্রিক সাধনার মূল লক্ষ্যই হলো মনের মানুষকে পাবার আকঙ্ক্ষা। আর এ লক্ষ্যেই বাউল দেহকে অবলম্বন করে স্থূল হতে সূক্ষ্মে, রূপ হতে স্বরূপে অগ্রসর হয়ে অবশেষে আত্মারূপী ‘মনের মানুষ’ ‘অধর সাঁই’, ‘অধর ফলা’, ‘অপর পরম চাঁদ’, ‘অচিন মানুষ’,‘অন্তর্যামী বা ‘জীবন দেবতার সন্ধান করা হয়।