প্রশ্নের উত্তর

বাউলগানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের বর্ণনা দাও।

অথবা, বাউলগান লালন ফকিরের সাধনার মাধ্যমে পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে— ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউলসঙ্গীতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে লালন শাহের অবস্থান নিরূপণ কর।
অথবা, বাউলগানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যা জান লেখ।
উত্তর।৷ভূমিকা :
বঙ্গদেশে হিন্দু এবং মুসলমান সমাজভুক্ত এক শ্রেণির সাধক-গায়ককে বাউল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। অনেকে বাউলকে বৈষ্ণব এবং ফকির ও দরবেশকে ইসলামি সমাজভুক্ত বিবেচনা করেন। অনেকে সর্ববঙ্গে একটি বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব কল্পনা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে, নির্দিষ্ট কেন্দ্র, কর্তৃত্ব, আচারাদির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ কোনো বাউল সম্প্রদায় বঙ্গে নেই। মুসলমান সমাজে আছে বাউল; হিন্দু সমাজে ফকির ও দরবেশের অভাব নেই। বাউল নামের আড়ালে নানা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন উপগোষ্ঠীর গায়ক, সাধক, ভণ্ড বেশধারী মানুষকে আবিষ্কার করা যায়। বাহ্যিক বেশভূষা, খাদ্যাখাদ্য এবং আচার আচরণে এদের বহু বৈচিত্র্য দৃষ্ট হয়। আধুনিককালের সূচনায় বাউলগান সমাজে প্রতিষ্ঠা ও অর্থ- মূল্য পাবার ফলে ‘সখের বাউল’ বা সাজা বাউলদের উদ্ভব ঘটেছে। বাউল শব্দটি সম্প্রদায় বাচক, না ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ নিয়ে সমস্যা আছে। অনেকে আউল বাউল, দরবেশ, সাঁই কে চারটি লৌকিক সম্প্রদায় বিবেচনা করেন। অনেকের মতে, সাধনার চারটি ক্রমিক স্তর এগুলো। দ্বিতীয় স্তর বাউলে, সাধকযুগল দেহ সাধনায় প্রবৃত্ত হয়। ত্রিকোণ যোনিমুদ্রা তাদের সাধ্য ও প্রণম্য; এই ত্রিকোণ ‘ব’তে মূলবস্তুর অনুসন্ধানকারী (ব + উল) বাউল। বাউল বস্তু (শুক্র) বাক্য (গুরুবাক্য) এবং ত্রিকোণ ‘ব’ এই তিন ‘ব’ এর সাধনা করে।
বাউল শব্দের উৎপত্তি : বাউল শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্নজনের মতে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ হতে। কেউ বলেন, বাউল শব্দটি ‘বাউর’ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। আবার ‘আকুল’ থেকে আউল এবং ব্যাকুল থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তিও কেউ কেউ স্বীকার করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেন বাতুল শব্দ থেকে ‘বাউল’ নামের উদ্ভব। দার্শনিক ডঃ ব্রজেন্দ্রনাথ শল বাউল শব্দটি ‘আউল’ শব্দজ বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে, আউল আরবি আউলিয়া সম্মত। উপরিউক্ত এ কয়টি
ব্যাখ্যার কোনোটিই উড়িয়ে দেবার মতো নয়। তবে সম্ভবত ব্যাকুল বা বাতুল থেকেই বাউল শব্দের উদ্ভব বলে মনে করা হয়। আমাদের এ অনুমানের স্বপক্ষে একটি যুক্তি এই যে, সমাজের স্তরে বাউলেরা কোনোকালেই শ্রদ্ধা বা মর্যাদার আসন পাননি। তাই অনুমান করছি ব্যাকুল বা বাতুল অর্থে উপহাস ছলে তাদের এ নাম করা হয়েছে। বাউল অর্থ বায়ুগ্রস্ত অর্থাৎ পাগল। বাউল সম্প্রদায়ের প্রাচীন নাম বায়ুর। বায়ুর > বাউল শব্দের উৎপত্তি। ভক্ত যখন বায়ুর মতো ভগবানের সাথে মিশে যেতে পারে তখনই তিনি প্রকৃত বাউল নামে অভিহিত হবার যোগ্য। বাউলের তত্ত্বকে কেন্দ্র করে যে মরমি সাহিত্য রচনা করেন তাকেই বাউল গান বলা হয়। বস্তুত বাউল গান লোকসাহিত্য নয় মাত্র। এগুলো এদেশের সাধারণ মানুষের কথা। মনীষার ফসল এবং সংস্কৃতির স্বাক্ষর জগৎ ও জীবনের সৃষ্টি ও স্রষ্টার গভীরতর রহস্য ও তত্ত্ব সহজভাবে বাউল গানে উচ্চারিত হয়েছে।
বিকাশ : মোটামুটি ১৭ শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকেই বাউল গানের উন্মেষ। আর উনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনাও সৃষ্টির মাধ্যমে এর পরিপূর্ণ সামাজিক ও তাত্ত্বিক বিকাশ ঘটে। যোগ ও সংখ্যা এ দুটো অতি পুরনো অনার্য দর্শন, পুরুষ ও প্রকৃতি তত্ত্বই সংখ্যা দর্শনের ভিত্তি। আর দেহটার দ্বারা মিশ্র তত্ত্বের উদ্ভব ঘটায়। ব্রাহ্মণ্য শৈবতন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্রের সংমিশ্রণে সম্ভবত সাত শতকের দিকে এক যোগীতান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এ তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায় বজ্রযান, কালচক্র যান ও সহজযান নামে তিনটি শাখায় বিভক্ত ছিল। বজ্রযান ও কালচক্রযান ধরে পরবর্তীকালের হিন্দুতান্ত্রিক ধর্মের বিকাশ ঘটে। আর সহজযান দুটো উপমার্গ ধরে পরিপুষ্ট
হতে থাকে। এর একটি কামাচার যোগ সাধনা এবং অপরটি প্রকৃতি বর্জিত যোগ চর্চা। প্রথমটি থেকে কালে বৈষ্ণর সহজিয়া মতের উদ্ভব হয়েছে এবং দ্বিতীয়টি পরবর্তীকালে বৈরাগ্যবাদী শৈব ধর্মের ভিত্তি হয়েছে এবং উভয় মতের মিশ্রণেই সম্ভবত বাউল মতের উদ্ভব। ছকে দেখলে এরূপ দাঁড়ায় :
লালনের আগেও কেউ কেউ বাউলগান লিখেছিলেন, কিন্তু তারা একটু গোপনীয়তা অবলম্বন করে চলতেন। অধিকাংশ বাউলের শুধু ভগিতা ছাড়া আর বিশেষ কিছু জানা যায়নি। তাই লালনের কবিত্ব শক্তি ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের জন্য সর্বাগ্রে তার কথা আলোচনা করা যেতে পারে। সুফিদের মতো লালন সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেছেন স্রষ্টার কাছে। বহিরঙ্গের চেয়ে অর্ন্তজগতের সাথে তার বেশি আনাগোনা। তার গান যেন এক একটি ভাবের ফুল- যেখানে ফুটুক না কেন তার গন্ধ দেশময় ছড়িয়ে পড়বেই। রবীন্দ্রনাথ লালনের বাউলগানের সম্পর্শে এসে মুগ্ধ হন। প্রধানত তাঁর জন্যই লালন ফকিরের নাম বাউল সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ সীমা ছাড়িয়ে আধুনিক শিক্ষিত সমাজে প্রচার লাভ করেছে। লালন অসংখ্য গান রচনা করেছেন। তার বিখ্যাত একটি গান হলো ‘এই মানুষের আছেরে মন পারিলাম না চিনিতে’।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, বাউলগানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের পরিণামে এসে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাউল ধর্মে বৈরাগ্য নেই। বাউল গান একান্তই বাঙালির মানস ফসল। তাই বাউল গান বাংলা সাহিত্যের এমন একটি ধারা যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে সমান মর্যাদার অধিকারী।

হ্যান্ডনোট থেকে সংগ্রহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!