অথবা, কীভাবে বাংলা নামের উৎপত্তি হয়? বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, বাংলা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে টীকা লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশের অভ্যুদয় কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন থেকে অনেক উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে এটি স্বাধীন হয়। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় চারটি প্রধান ইউনিট ছিল। এর মধ্যে গৌড় ও বঙ্গ কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুপ্রাচীনকাল থেকে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কখনো বঙ্গ-গঙ্গারিডাই, পুণ্ড্র, গৌড় ও বাঙ্গাল দেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘বঙ্গ’ ধীরে ধীরে বাঙ্গালা নাম ধারণ করে এবং পরবর্তীতে বেঙ্গলে রূপান্তরিত হয়। অনেকগুলো উৎসের অবতারণা করা হয়। এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
বাংলা নামের উৎপত্তি : বাংলা নামের উৎপত্তিতে মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। নিচে সে সম্পর্কে
পৌরাণিক কাহিনি : প্রাচীনকালের ধর্মীয় প্রথার পুরাণে বলা হয় অন্ধমুনীর গর্ভে ৫ জন সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এর মধ্যে একজনের নাম ছিল ‘বঙ্গ’। তিনি পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। তাঁর এবং তাঁর বংশধরদের থেকে পরবর্তীতে ‘বঙ্গ’ নামের উৎপত্তি হয়। পরিমার্জিত হয়ে বিভিন্ন সংযোজনের মাধ্যমে এটা বাংলা নাম ধারণ করে রিয়াজ-উস-সালাতীন এ বলা হয়, হযরত নূহ (আ) এর এক বংশধর ছিল। তার নাম ছিল ‘বঙ্গ’। তার নাম থেকেই বঙ্গ নামের উৎপত্তি। এ সকল উৎস থেকে বলা যায় প্রাচীনকালে হয়ত এমন কোনো পরাক্রমশালী রাজা ছিল যার নামানুসারে বঙ্গ নামের উৎপত্তি হয়।
চীনা ও তিব্বতি শব্দের মিল : ‘বঙ্গ’কে অনেকে চীনা ও তিব্বতি শব্দ বলে উল্লেখ করেন। বঙ্গের ‘অং’ অংশের সাথে ‘গঙ্গা’ হোয়াংহো ইয়াংসিকিয়াং ইত্যাদি নদীর নামের সাথে মিল রয়েছে। বাংলায় যেহেতু অনেক জলাশয়েরও নাম রয়েছে তাই একে বঙ্গ বলা হয়। সুকুমার সেনের মতে, বঙ্গের আর একটা অর্থ হলো ‘কার্পাস তুলা’। প্রাচীনকালের গ্রিক-রোমান- ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চলের সুতার প্রশংসা করেছেন। ‘পেরিপ্লাস অব দ্য ইরিথ্রিয়ান সী’ ‘ইন্ডিকা’ ইত্যাদি গ্রন্থে এ সম্পর্কে তথ্য রয়েছে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র : খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বঙ্গের ‘শ্বেত স্নিগ্ধ’ সুতি বস্ত্রের নাম বলা হয়েছে। এটা সুকুমার সেনের মতকে সমর্থন করে। সুকুমার সেনের মতে, অনেক তুলা উৎপাদন হতো বিধায় এ অঞ্চলের নাম ‘বঙ্গ’ হয়েছে।
আবুল ফজল : মুঘল আমলে এ ভূভাগ ‘সুবা বাঙ্গালা’ নামে পরিচিত ছিল। আবুল ফজল ‘বাঙ্গালা’ নামের ব্যাখ্যায় তার গ্রন্থে বলেন, বাঙ্গালার আদি নাম ছিল বঙ্গ। প্রাচীনকালে এখানে জলাবদ্ধ হতো বলে এর রাজারা ১০ গজ উঁচু ও ২০ গজ বিস্তৃত প্ৰকাণ্ডে ‘আল’ নির্মাণ করতো। বঙ্গের সাথে ‘আল’ যুক্ত হয়ে ‘বাঙ্গাল’ বা ‘বাঙ্গালা’ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে আবুল ফজল মনে করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতামত: রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, প্রাচীনকাল থেকেই ‘বঙ্গ’ ও ‘বাঙ্গাল’ দুটি পৃথক দেশ ছিল। বাঙ্গাল দেশের নাম হতেই কালক্রমে সমগ্র দেশের নাম বাংলা নামকরণ করা হয়। বর্তমান কালে বাংলাদেশের অধিবাসীদের যে ‘বাঙ্গাল’ বলা হয় তা সেই প্রাচীন ‘বাঙ্গাল’ দেশের স্মৃতি বহন করে।
আ. মমিন চৌধুরীর মতামত: অধ্যাপক আব্দুল মমিন চৌধুরী বলেন, বাংলার প্রাচীন জনপদের মধ্যে ‘বাঙ্গাল’ কখনো ‘বঙ্গের’ তুলনায় খ্যাতিমান ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তাঁর মতে, বঙ্গের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার অনেক জনপদ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি বলেন, বাঙ্গাল বঙ্গের সমুদ্রতীরবর্তী দক্ষিণ ভাগ ছিল। এ সবের ভিত্তিতে নদীমাতৃক বৃষ্টি বহুল এ বাংলায় ‘আল’ নির্মাণ করায় বঙ্গ থেকেই বাংলা নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। নীহাররঞ্জন রায় ও আব্দুল মমিন চৌধুরী এ ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, বাংলা নামের উৎপত্তিতে নানা মতামত প্রচলিত থাকলেও বঙ্গ থেকে বাংলার উৎপ ত্তি বলে অনেক ঐতিহাসিক, পণ্ডিত মনে করেন। এ বঙ্গই প্রাচীনকালে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অস্তিত্ব ছিল। পরবর্তীতে বঙ্গের অধীনে অনেক এলাকা আসে যা ধীরে ধীরে বাংলা নাম ধারণ করে।

admin

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!