• June 4, 2023

বাংলাদেশ দর্শনে বরকতুলাহ ও আবুল হাশিমের দার্শনিক মতামত ব্যক্ত কর।

অথবা, বরকতুল্লাহ ও আবুল হাশিমের দর্শনের বর্ণনা দাও।
অথবা, বরকতুল্লাহ ও আবুল হাশিমের দর্শনের ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বরকতুল্লাহ ও আবুল হাশিমের দর্শনের আলোচনা কর।
উত্তর।। ভূমিকা :
যে প্রজ্ঞাময় দর্শন বাংলাদেশের আবহমানকালের বিশাল পটভূমিতে প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে এ সময় পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে তাই বাংলাদেশ দর্শন। আর এ বাংলাদেশ দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যাদের নাম অগ্রগণ্য, তাঁদের মধ্যে বরকতুল্লাহ ও আবুল হাশিমকেও পাওয়া যায়।বাংলাদেশ দর্শনে তাদের ভূমিকা রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। তাই বাংলাদেশ দর্শনে বরকতুল্লাহ ও আবুল হাশিম সম্বন্ধে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
বরকতুল্লাহ : মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ (১৮৯৮-১৯৭৪) জন্মগ্রহণ করেন পাবনা জেলার শাহজাদপুর থানার ঘোড়াশাল গ্রামে। দর্শন ও আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করা ছাড়াও তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রতিযোগিতামূলক বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় এবং উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কৃতিত্বের সাথে। কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি নিষ্ঠার সাথে অব্যাহত রাখেন তাঁর সাহিত্যিক ও দার্শনিক কর্ম। ‘পারস্য প্রতিভা’ ও ‘মানুষের ধর্ম’ তাঁর অকৃত্রিম বিদ্যানুরাগেরই দুটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। নিম্নে তাঁর দার্শনিক চিন্তা বর্ণনা করা হলো :
১. আত্মা সম্পর্কিত মত : আত্মপ্রতিষ্ঠাকে বরকতুল্লাহ ঘোষণা করেছেন তাঁর দার্শনিক চিন্তার কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য।হিসেবে। তাঁর মতে, আপ্রতিষ্ঠা জগতের এক স্বাভাবিক ও চিরন্তন ধর্ম। অচেতন জড়বস্তু থেকে শুরু করে সচেতন জীব পর্যন্ত সর্বত্র লক্ষ্য করা যায় এ স্বাভাবিক ধর্মের অভিব্যক্তি। আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অধিকতর বিস্তৃত জীবজগতে। জীব বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট হয় না, নিজেকে প্রসারিত করতে চায় কালের প্রবাহে, অমরত্ব অর্জন করতে চায় সুকৃতি ও সন্তানসন্ততির মাধ্যমে। প্রাণিজগতের অন্যান্য সদস্য ও মানুষের মধ্যে এ এক অভিন্নভাবে উপস্থিত থাকলেও মানুষ অর্জন করেছে এক বিশেষ শক্তি। এ শক্তির নাম আত্মা। আত্মাও অমরত্বে অভিলাষী। প্রকৃতি জগতে ও জীবজগতে বিবর্তন যেমন অবিরত অগ্রসরমান, আত্মাও তেমনি তার নিজস্ব জগতে বেঁচে থাকবে, আপন কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে- এটাই তার আশা ও বিশ্বাস। এ বিশ্বাস থেকেই মানুষ রচনা করেছে পরলোকে তার বাসস্থান সম্পর্কে এক চমৎকার চিত্র, কল্পনা করেছে প্রাসাদোপম অট্টালিকা, মনোরম উদ্যান ও স্রোতস্বিনী সংবলিত স্বর্গীয় পরিবেশের কথা।
২. জ্ঞান লাভের উপায় : বহির্জগৎ সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের বাহন মানুষের ইন্দ্রিয়। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সবকিছু জানা যায় না। জ্ঞানার্জনে বুদ্ধিবৃত্তির ভূমিকা কোনমতেই উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু মানবজীবন ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিবৃত্তির যোগফলই নয় তার চেয়ে বৃহত্তর একটা সত্তা, এমন সত্তা যা গঠিত বুদ্ধিবৃত্তি এবং আরো অনেক কিছু নিয়ে। বুদ্ধি ছাড়াও তাই স্বীকার করতে হয় প্রবৃত্তি (Instinct) ও স্বজ্ঞা (Intuition) নামক জ্ঞানের অন্যান্য বাহনকে। স্বজ্ঞাকে বর্ণনা করা যায় অতীন্দ্রিয় অনুভবশক্তি বলে। এ ধরনের একটি শক্তি যে ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তির সাথে যুক্ত এবং তা যে উচ্চতর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের একটি অনিবার্য ও ফলপ্রসূ বাহন তা সন্দেহ করার কারণ নেই। এ উচ্চতর জ্ঞানশক্তির উপস্থিতির কারণেই সসীম মানুষ প্রয়াসী হয় তার মধ্যে অসীমকে খুঁজে পাওয়ায়, আদর্শকে বাস্তবায়িত করায়। তাইতো বাস্তবকে অতিক্রম করে আদর্শ অর্জনের জন্য মানুষের এতো প্রচেষ্টা। এক আদর্শ অর্জনের পর মানুষ শুরু করে তার চেয়েও উচ্চতর আরো নতুন কিছু আদর্শ অর্জনের। পরলোক কিংবা স্রষ্টার ব্যাপারে কৌতূহল মানুষের এ প্রেরণারই বহিঃপ্রকাশস্বরূপ।
৩. পরমাত্মা : জ্ঞান ও সত্যের প্রকৃত সাধক গভীর মনোযোগ দ্বারা প্রগাঢ় অন্তর্দৃষ্টি অর্জনে সক্ষম। তাইতো ভ াবুক সাধকরা হরিণের ন্যায় বাহ্যজগতে কম্ব্ররীর সন্ধান করেন না, বরং নিজের অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করেন চরম ও পরমসত্তাকে। সাধনায় সত্যিকার অর্থে যারা এক্ষেত্রে সিদ্ধিলাভ দ্বারা পরম চেতনার সন্ধান পেয়েছেন, মরণ তাদের স্পর্শ করতে পারে না। জড় দেহ বিনষ্ট হলেও তাঁদের আত্মা অমর, অবিনশ্বর। সমগ্র বিশ্বচরাচর জুড়ে প্রবহমান রয়েছে একটি প্রেরণা, একটি সচেতন অভিব্যক্তি। জড় বস্তুর চেতনা নেই কিন্তু এর যে প্রেরণা, তা শুধু সচেতনই নয়, সুনিয়ন্ত্রিত ও সুচালিত। ফলে এর পিছনে যে একজন চালক ও নিয়ন্ত্রক আছেন, তা নিশ্চিত বুঝা যায়। মানুষ এ প্রেরণার এবং বিবর্তনধারার বাইরে নয়। মানুষের ধর্ম তার সসীম গণ্ডি অতিক্রম করে অসীমের সাথে একাত্ম হওয়া। শাশ্বত সত্যে মানুষের সাথে এই যে একাত্মতার অনুভূতি তাতেই সার্থকতা। আত্মা নিজেকে সর্বতোভাবে আত্মস্থ মনে করে একমাত্র সনাতন পরমার্থে।
৪. নীতিবোধ : ন্যায়, সুনীতি, কল্যাণ, সৌন্দর্য প্রভৃতি মানবজীবনের তাৎপর্যপূর্ণ ঐশ্বর্যস্বরূপ। এগুলোর স্বীকৃতি ও লালনেই নিহিত মানুষের স্বকীয়তা ও মহত্ত্ব। যে ন্যায়শাস্ত্র এ সনাতন মূল্যবোধকে অস্বীকার করে, তার ব্যবস্থা মানবসমাজে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, বরং সূত্রপাত করে বিপদ ও প্রলয়ের। আপন অধিকারবোধ এবং অপরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। ন্যায় ও সুনীতির ধারাকে যিনি সশ্রদ্ধচিত্তে মান্য করে চলেছেন, তিনি ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে জামত দেখেন পরম নিত্য, সত্য ও সত্তাকে। তাঁর পক্ষেই সম্ভব মানুষকে প্রকৃত মানুষরূপে শনাক্ত করা। এ জাতীয় মানুষ যথার্থই উপলব্ধি করেন, তাঁরা স্বাধীন; অপরের স্বাধীনতাকে হরণ বা অতিক্রম করে নয় বরং এক বৃহত্তর স্বাধীন সত্তার অংশ হিসেবে। তাঁদের স্বাধীনতা ও সার্থকতা সংকীর্ণ ব্যক্তিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, পরিব্যাপ্ত ও পরিস্ফুট সবার মধ্যে।
আবুল হাশিম : বাংলাদেশের অপর এক বরেণ্য চিন্তাবিদ হলেন আবুল হাশিম (১৯০৫-১৯৭৪)। জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান হলেও তাঁর পরবর্তী দার্শনিক ও লেখক জীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলাদেশে। তিনি শুধু যে একজন বিচারশীল দার্শনিক তাই নয়, তাঁর চিন্তা, রচনা ও কর্ম সমানভাবে বিস্তৃত ছিল রাজনীতি ও ধর্মতত্ত্বে। ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর The Creed of Islam’ গ্রন্থটি মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে অনন্য একটি সংযোজন।
১. যথার্থ দর্শনের স্বরূপ: দর্শনের স্বরূপ ও উপযোগিতা এবং দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা সম্পর্কে আবুল হাশিমের মতো বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, বাস্তব জীবনের সাথে যে দর্শনের কোন সম্পর্ক নেই, যা নিতান্তই ধারণা বা তত্ত্বের চার দেওয়ালে সীমাবদ্ধ, তার কোন মূল্য নেই। সুতরাং জীবনদর্শন নিয়ে চিন্তাভাবনায় আগ্রহী প্রত্যেকের উচিত মাটির পৃথিবীতে শক্ত পায়ে অবস্থান গ্রহণ এবং অবাস্তব আকাশচারী তত্ত্বানুসন্ধান পরিহার করা। যথার্থ দর্শন নিছক তত্ত্বচিন্তা নয়, বরং জীবনযাপনের ব্যাপারে একটি দৃষ্টিভঙ্গি। পরিচিত প্রতিটি দার্শনিক মতাদর্শের একটি স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। যেমন- হিটলার ও মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট ও নাৎসি দর্শনে দুর্বলের উপরে সবলের বলপ্রয়োগই বাস্তব সত্য। এছাড়া নীতিবোধ, মূল্যবোধ, মানবতা প্রভৃতি শুধু কথার কথা, নিছক ভাবালুতা। অন্যদিকে, কমিউনিজমের মূলনীতি নিহিত বস্তুসত্তাকেই পরমসত্তা হিসেবে গ্রহণ করায়। এ মতে, মৃত্যুতে দেহ বিনাশের সাথে সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটে। ঈশ্বর, আত্মা, পরলোক, বেহেশত, দোযখ প্রভৃতি সবই অবাস্তব, অনেকটা আফিমের নেশার মতো আকাশকুসুম চিন্তা। অন্যান্য দর্শনের মতো মুসলিম দর্শনও একটি ভাবাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত।
২. বস্তুবাদী চিন্তাধারা ও নৈতিক মূল্যবোধের সমন্বয় : আবুল হাশিম এর মতে, “প্রক ৃত সভ্যতা কোন বিশেষ আঞ্চলিক ব্যাপার নয়, সভ্যতা মাত্রই বিশ্ব সভ্যতা।” সত্যিকারের সভ্যতার একটি বিশ্বজনীন আবেদন থাকতেই হবে। সভ্যতার আবির্ভাব সূর্যোদয়ের মতো। আজকের দিনের বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতা উপনীত হয়েছে উন্নতির শীর্ষে। আর সেই সাথে শেষ হয়েছে মানবজাতির ঊর্ধ্বতনে এর প্রগতিশীল ভূমিকা। তাই বস্তুতান্ত্রিক উন্নতি সত্ত্বেও আজ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির
অভ্যন্তরে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। হাশিমের মতে, “আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি উদাসীনতা এবং বৈষয়িক ও জড়ীয় ভোগ সম্ভোগের উপর অতিশয় আকর্ষণই এ অনাসৃষ্টির মূল কারণ।” সুতরাং এ বস্তুবাদী দর্শন যে সময়ের স্বাভাবিক গতিতে বিলীন হয়ে যাবে, তাতে সন্দেহের কিছু নেই। এ পরিস্থিতিতে সচেতন মানুষের উচিত হবে এ মর্মে সতর্ক থাকা, যেন এ বস্তুবাদী দর্শন নিজে ডুবার সময় সমগ্র মানবজাতিকেও ডুবিয়ে ফেলতে না পারে। এ সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করতে হবে এমন এক বিশ্বজনীন পদ্ধতি, যা কি না ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হবে বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের মধ্যে। আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণাকে এ ধরনের নেশা বা বাতিক বলে মনে করার বস্তুবাদী পরামর্শ বর্জন এবং প্রকৃতির নিয়মাবলি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন আমাদের পরম কর্তব্য। এ জ্ঞানার্জনের ফলেই বুঝা যাবে যে, প্রকৃতির নিয়মাবলি আসলে প্রকৃতি জগতে কার্যরত আল্লাহর ইচ্ছারই প্রকাশস্বরূপ। এভাবে প্রকৃতির নিয়মাবলির অস্তিত্ব ও কার্যকারিতা স্বীকার করার অর্থ হবে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা। মোটকথা, একদিকে সৃষ্টিকর্তার দাসত্বের স্বীকৃতি এবং অন্যদিকে পৃথিবীর উপর মানুষের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা এ দ্বৈত প্রয়াসেই নিহিত আদর্শ জীবনদর্শন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, আধুনিক বাংলাদেশের দার্শনিকদের মধ্যে বরকতুল্লাহ ও আবুল হাশিম অন্যতম। তাঁরা দু’জনই জ্ঞান লাভের পন্থা হিসেবে স্বজ্ঞাকে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা উভয়ই একথা স্বীকার করেছেন যে, বিশ্বের সার্বিক কল্যাণের জন্য বস্তুবাদ । অধ্যাত্মবাদ তথা নৈতিকতার সমন্বয় ঘটাতে হবে। আর এ মূল্যবান দার্শনিক মতের জন্য তাঁরা উভয়ই বাংলাদেশ দর্শনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।

হ্যান্ডনোট থেকে সংগ্রহীত
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!