অথবা, বাংলাদেশের সামাজিক বিষয়াদির খুঁটিনাটি ব্যাখ্যায় সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর?
উত্তর৷ ভূমিকা :
তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম হাজারো সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম অধ্যাপক এ.কে. নাজমুল করিম ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান পাঠের দিগন্ত উন্মোচন করেন। এদেশের সামাজিক ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান অপরিহার্য।

বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা : নিম্নে বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিক শ্রেণি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ : প্রত্যেক সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি বা গোষ্ঠীর লোক বাস করে। সমাজের এসব গোষ্ঠী বা শ্রেণির মধ্যকার সম্পর্ক, উৎপাদন যন্ত্রের সাথে তাদের সম্পর্ক, ভূমিকা বা অবদান এবং অধিকার সম্পর্কে জানতে হলে সমাজবিজ্ঞান পাঠ করা আবশ্যক। কেননা সমাজতত্ত্বে এসব বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়ে থাকে।
২. সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন : বাংলাদেশের সমাজ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জনের জন্য সমাজবিজ্ঞান পাঠ আবশ্যক। আবহমান কাল থেকে বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজ বিকাশলাভ করেছে। বাংলাদেশের সমাজ কিভাবে গড়ে উঠেছে, কিভাবে বিকাশলাভ করছে, সমাজ কিভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে ইত্যাদি বিষয় জানতে হলে আমাদের অবশ্যই সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। কেননা, সমাজবিজ্ঞানই একমাত্র বিজ্ঞান, যা সমাজের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করে।
৩. সমাজকাঠামো জানতে: সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম কেন্দ্রীয় প্রত্যয় হচ্ছে সমাজকাঠামো। বাংলাদেশের সমাজকাঠামোর পরিবর্তন ও বিকাশ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন করতে হলে সমাজবিজ্ঞান পাঠ অত্যাবশ্যক।
৪. সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে জানতে : বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ। এদেশ হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু এসব সমস্যার মূল বা গোড়া কোথায়, কি কারণে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, তা নিয়ে আমাদের চিন্তা নেই। কারণ চিন্তা করার মত সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান আমাদের নেই। আর এজন্যই বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।
৫. সামাজিক সমস্যা সমাধানে : বাংলাদেশের সমাজ আজ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এসব সমস্যার সমাধান বের করতে হলে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান অপরিহার্য। আমরা জানি যে, সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এ পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজস্থ মানুষের কি কর্তব্য রয়েছে সমাজবিজ্ঞান সে সম্পর্কে জ্ঞান দান করে থাকে।
৬. সমাজের মানুষ সম্পর্কে জানতে : শুধু সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করলে চলবে না। সমাজে বসবাসকারী মানুষ তথা বাঙালির জীবনযাপন পদ্ধতি, আচার আচরণ, রীতিনীতি, চালচলন তথা জীবনপ্রণালী সমাজবিজ্ঞান আলোচনা করে। তাই বাংলাদেশের মানুষের জীবনপ্রণালী তথা মানুষ সম্পর্কে জানতে হলে সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।
৭. উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে : বাংলাদেশের বিভিন্নমুখী সামাজিক সমস্যার আলোকে যদি কোন পরিকল্পনা প্রণয়ন
করা না হয়, তাহলে তা যথার্থভাবে বাস্তবায়িত হয় না সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে। তাই উন্নয়নের ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।
৮. ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সম্পর্কে জানতে : সমাজের ব্যক্তি তথা গোষ্ঠীর চেতনার উপর সমাজের উন্নতি নির্ভর করে। ব্যক্তির একার পক্ষে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বেলায়ও এর কোন ব্যতিক্রম নেই। আর গোষ্ঠী চেতনা লাভ করতে হলে সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। তবে উন্নত পাশ্চাত্য সমাজবিজ্ঞানের আলোকে বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞান পাঠ করতে হবে।
৯. সামাজিক উন্নয়নে : সামাজিক উন্নয়নে সমাজবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজকে উন্নত থেকে উন্নততর করতে হলে এবং জীবনের মূল্যবোধকে ব্যক্তি চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হলে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জন করা বাঞ্ছনীয় । প্রতিনিয়ত আমাদের চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটছে এবং জীবনের মূল্যবোধকে সজাগ দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষণ করছি। কিন্তু এসব কেন হচ্ছে তার উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য সমাজবিজ্ঞান পাঠ করা একান্ত অপরিহার্য।
১০. সমাজের গতিপ্রকৃতি জানতে : বিভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজ ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। এর সাথে সাথে সমাজের গতিপ্রকৃতিরও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তাই সমাজের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানতে হলে সমাজবিজ্ঞান পাঠ অপরিহার্য।
১১. সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানতে : বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকদের কি ধরনের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে সমাজবিজ্ঞান তার প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। সমাজবিজ্ঞান পাঠে শুধু সামাজিক অধিকার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় তা নয়, বরং সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেও জ্ঞান লাভ করা যায়।
১২. সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে জানতে : সমাজবিজ্ঞান ব্যক্তি, গোষ্ঠী তথা গোটা সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে অধ্যয়ন করে। বাংলাদেশের সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে জানতে হলে সমাজবিজ্ঞান পাঠ করতে হবে।
১৩. সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানে : বাংলাদেশের সমাজ, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী সম্পর্কে নিবিড় জ্ঞান অর্জন করতে হলে সমাজবিজ্ঞান পাঠ অত্যাবশ্যক । সমাজবিজ্ঞান পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন সমাজের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও লেনদেন বৃদ্ধি পায় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম অনগ্রসর ও কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ অনুন্নত গ্রামীণ সমাজে বসবাস করে। তাছাড়া এদেশে শিক্ষার হার কম বলে উন্নত সমাজ সম্পর্কেও মানুষ সচেতন নয়। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সমাজের পূর্ণাঙ্গ পাঠ হিসেবে সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a5%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b8%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%9e/
admin

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!