বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছয় দফার গুরুত্ব আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছয়দফার ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ছয়দফার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধর।
অথবা, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা ছিল এই ছয়দফা”—ব্যাখ্যা কর।
উত্তর ভূমিকা : ৬
দফা কর্মসূচি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালি জাতির কাছে ম্যাগনাকার্টা স্বরূপ। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে সকল শোষিত ও নির্যাতিত জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনদান করে। ফলে দিনে দিনে ৬ দফা কর্মসূচির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ৬ দফার এ জনপ্রিয়তার জোরেই আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ।
১৯৬৬ সালের ৬ দফার গুরুত্ব বা তাৎপর্য : নিম্নে ১৯৬৬ সালের ৬ দফার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. প্রথম লিখিত প্রতিবাদ : তাৎপর্যগত দিক থেকে ছয়দফা ছিল মূল্যবান। আওয়ামী লীগের ছয়দফা দাবি ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের অনাচার ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন, ৬ দফা বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুর, মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ। ৬ দফা শোষকের হাত থেকে শাষিতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে আনার হাতিয়ার। ৬ দফা হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধদের নিয়ে গঠিত বাঙালির স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি।
২. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা : সরকারবিরোধী পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতাদের দমন করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে একটি মামলা শেখ মুজিবসহ অন্যান্য ৩৫ জনের নামে পেশ করেন। এ মামলা করার পর সরকার শেখ মুজিবকে বন্দী করেন। তবে এ মামলা বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে সরকার পারেন নি। তাই ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহরুল
হককে হত্যার পর পরিবেশ এত প্রতিকূল হয় যে, মামলা প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হয়।
৩. পশ্চিমা শাসক চক্রের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আক্রমণ : ৬ দফার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিমা শাসক চক্রকে আঘাত হানে। তাই এ দফা প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে সরকারের টনক নড়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার ও প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থি দলগুলোর মধ্যে বিরূপ মনোভাব দেখা দেয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ৬ দফার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা ব্যবহারের হুমকি দেন। তার নির্দেশে পুতুল গভর্নর মোনেম খান, শেখ মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা মামলা দায়ের করে অযথা তাদের হয়রানি ও নির্যাতন চালান।
৪. সরকারের দমননীতি : পূর্বের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে, বাঙালিরা যখনই ন্যায্য দাবি তুলেছে, তখনই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র তাদের কণ্ঠরোধ করার জন্য সকল প্রকার দমন নীতি গ্রহণ করেন। ৬ দফা আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকার নির্যাতনমূলক নীতি গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করলে ঢাকা

শহরে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৩ মে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। ৭ জুন আওয়ামী লীগ: হরতালের ডাক দেন। সরকার হরতাল বন্ধ করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। হরতালের প্রাক্কালে বিভিন্ন ঘটনায় মোট ১১ ব্যক্তি নিহত হন। এ ঘটনায় সবাই সরকারের নিন্দা জ্ঞাপন করেন।
৫. স্বায়ত্তশাসনের পথ প্রশস্ত : ১৯৬৬ সালের ৬ দফার মাধ্যমে বাঙালিরা প্রথম লিখিতভাবে স্বায়ত্তশাসনের দাবি পেশ করেন। এ প্রস্তাবে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা আবাস ভূমির প্রস্তাব করা হয়। তবে এ স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ ছিল না। পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল সরকার এটা দমন করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়।
৬. বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ : এ ৬ দফার মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে শাসকবর্গ যে বৈষম্যের পাহাড় সৃষ্টি করেন তার প্রতিবাদ জানানো হয়। এক্ষেত্রে প্রকাশ্য বৈষম্য যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান ছিল তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয় । তবে সরকারকে এটা অবগত করা হলেও অতি সহজে সফল হওয়া যায়নি। এজন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।
৭. পাকিস্তান বিভক্ত তথা বাংলাদেশের বীজ নিহিত : ঐতিহাসিক ৬ দফা ছিল বাঙালিদের বাঁচার দাবি। এ দাবি পূরণ করতে গিয়ে বাঙালিরা বুকের তাজা রক্ত দিতে সর্বদা প্রস্তুত ছিল। এ ৬ দফার মাধ্যমে বাঙালিদের যে সাফল্য লাভ করার কৌশল বা সামর্থ্য আছে তা প্রমাণিত হয়। এছাড়া দেখা যায়, ১৯৭১ সালে যে মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাঙালিরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন, তার বীজ এ ৬ দফার মাধ্যমে রোপণ করা হয়েছিল। ৬ দফা সম্পর্কে রওনক জাহান বলেছেন, “৬ দফা আন্দোলন ক্ষণস্থায়ী হলেও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে অনেকটা ভূমিকা পালন করেছিল ।” ৬ দফা সম্পর্কে অনেকে একে বাঙালিদের স্বাধীনতার দলিলপত্র বলে মন্তব্য করেছেন। অনেকের মতে, আজকের যে স্বাধীন বাংলাদেশ তার ভিত্তি ছিল ৬ দফা।
৮. আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবরের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা : ইতঃপূর্বে ১৯৫৪ সালে যে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল সেখানে পাকিস্তানের কয়েকটি দল ছিল। কিন্তু ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালির মুক্তির সনদস্বরূপ বিখ্যাত ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এতে একদিকে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব
প্রতিষ্ঠা হয় । তাই এদিক থেকে আওয়ামী লীগের জন্য ৬ দফা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে,

ইতিহাসে ৬ দফা কর্মসূচি এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা ৬ দফা ছিল বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুর, মধ্যবিত্ত তথা আপামর জনসাধারণের মুক্তির সনদ। বলা যায় এটি ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ ।