অথবা, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমলাদের কার্যাবলি আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমলাদের কী কী ভূমিকা রয়েছে?
উত্তর৷ ভূমিকা : আমলাতন্ত্র আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। পৃথিবীতে রাষ্ট্র সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই আমলাতন্ত্র তার যাত্রা শুরু করে। কেননা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শাসনতন্ত্র এবং তার প্রয়োজনে আমলাতন্ত্র । তাই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রই কোন না কোন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আর তাই আমলাতন্ত্রকে রাষ্ট্রের প্রাণ বলা হয়।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমলাদের ভূমিকা (Role of bureaucracy in socio-economic development of Bangladesh) : আমলারাই অনুন্নত দেশের উন্নয়নে অধিকাংশ পলিসি তৈরি করে থাকে । ফলে উন্নয়ন সঠিক নিয়মে হচ্ছে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. সর্বদা নিয়মের বরখেলাপ : আমলারা কথায় কথায় নিয়মের কথা বলে থাকেন। ফলে যে কোন কাজ যা অতি সহজে হয়ে যাওয়ার কথা তার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। এর ফলে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত এত বিলম্বে আসে যে, সেটি আর কখনো ঠিক সময়ে বাস্তবায়িত হয় না। ট্যাসিটাস (Tacitus) বলেছেন, “The more corrupt the state, the more laws.” সারা পৃথিবীর সকল দেশে আমলাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ রয়েছে, তবে অনুন্নত দেশে এর প্রবণতা বেশি।
২. জনগণের সাথে দূরত্ব বজায় রাখা : আমলারা অকারণে জনগণের সাথে দূরত্ব বজায় রাখেন। তারা জনগণের সেবক নয়, শাসক। এ কথাটি অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করার জন্য বিশেষ দূরত্ব বজায় রাখেন। সহজে যেন কোন ক্ষতিগ্রস্ত।ব্যক্তি তাদের সাথে দেখা করতে না পারেন, সেজন্য তারা সবসময় দূরত্ব বজায় রাখেন। এভাবে জনগণকে সবসময় হেয় করার চেষ্টা করে থাকেন।
৩. অকারণে সিদ্ধান্তে বিলম্ব করা : অতি সামান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর বিলম্ব করা হয়। কোন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক দিন সময় নিয়ে থাকেন এবং অনেক সময় যখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তখন তার গুরুত্ব লোপ পায় বা প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়। যেমন- ঘূর্ণিঝড় হলে তার পর পর সে এলাকায় হয়ত
ব্যাংক ঋণ প্রদান করার প্রয়োজন। কিন্তু দেখা গেল যে, কত টাকা মোট ঋণ দেয়া হবে, কি কি মানদণ্ড অনুসরণ করে কাদেরকে ঋণ দেয়া হবে, কোথায় কোথায় দেয়া হবে ইত্যাদি বিষয়ে হাজারও প্রশ্ন উত্থাপন করে বিষয়টির ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত না দিয়ে ফেলে রেখে বিদেশে কোন শিক্ষা সফরে চলে গেল।
৪. মতামতে অনীহা প্রদান : কোন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যদি প্রতিকার দাবি করে কোন দরখাস্ত প্রদান করেন, তাহলে তার উত্তর না দেয়া। যদি ব্যক্তি অফিসে যায়, তাহলে তাকে দেখা করার সুযোগ না দেয়া। আবার যদি দেখা করতে সমর্থ হয়, তাহলে ফাইল থেকে সে দরখাস্ত গায়েব করে দেয়া। একসময় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি হয় নিজেই আর তার পিছু নেবে না, নতুবা
বেশি বিরক্তবোধ করলে নেতিবাচক একটি আইনগত দিক উল্লেখ করে তাকে হয়রানি করার ব্যবস্থা করবে।
৫. জবাবদিহিতা না থাকা : আমলাদের কোন জবাবদিহিতা নেই, ফলে আমলারা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো কাজ।করে যায়। একজন আমলা আরেকজন আমলার কর্মকাণ্ড তদারকি করে, ফলে একজন আরেকজনকে রক্ষা করে। এতে।করে দেখা যায় যে, সার্বিকভাবে তাদের কোন কাজে জবাবদিহি করতে হয় না। তারা দায়িত্ব পালন না করলেও তেমন কিছু আসে যায় না। কারণ এমন কোন ব্যক্তি নেই কাগজকলমে আছে যার কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কোন ক্ষতিগ্রস্ত
ব্যক্তি যদি তাদের কাছে প্রতিকারের জন্য যায়, তাহলে তাকে এমনকি দেখা করতে
ও দেয়া হয় না।
৬. সরকারি সম্পত্তির অপচয় করা : আমলাদের আরেকটি বড় ধরনের আচরণ হচ্ছে সরকারি সম্পত্তির অপচয়। প্রতিটি আমলা (ব্যতিক্রম বাদে) কমপক্ষে ২-৩টি গাড়ি ব্যবহার করেন। একজন মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তার কাছে কমপক্ষে দুটি গাড়ি থাকে। একটি নিজে ব্যবহার করেন, একটি স্ত্রীর জন্য এবং কোন সময় স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা ব্যবহার করে। নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দকৃত গাড়ি নিয়ে কিংবা ভিআইপি কার ব্যবহার করে থাকেন। যার জন্য মাসে মাসে সরকারের হাজার হাজার টাকা অপচয় হচ্ছে। ঠিক একইভাবে যেসব পদে কোন লোকের প্রয়োজন নেই, সেসব পদে লোক নিয়োগ করে তাদেরকে নিজের বাসায় ব্যবহার করছে।
৭. ঘুষ দুর্নীতিতে বুদ হয়ে থাকা : আমলাদের আরেকটি প্রধান আচরণ হলো ঘুষ দুর্নীতিতে বুদ হয়ে থাকা। একজন আমলা যে পরিমাণ বেতন পায়, তার চেয়ে বেশি টাকা বিলাসব্যসনে খরচ করে। সুতরাং তার পুরো সংসার কিভাবে চলে।এবং বছরে লক্ষ লক্ষ টাকা কি করে ব্যাংকে জমা হয়, স্ত্রীর নামে কি করে দামি বাড়ি বা ফ্লাট ক্রয় করা হয় তা সহজেই।অনুমেয়। ঘুষ দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, নেপাল, মিশর প্রভৃতি দেশের নামে আজকাল বিশেষভাবে আলোচিত। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কোন কোন দেশ এ ধরনের ঘুষ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে।
৮. অদক্ষতা দূর না করার চেষ্টা করা : আমলাদের আরেকটি বড় ধরনের আচরণগত সমস্যা হচ্ছে স্বীয় অদক্ষতা দূর।না করা। তারা যুগ যুগ ধরে একটি কাজ করে যাচ্ছে অত্যন্ত অদক্ষতার সাথে। কিন্তু সে বিষয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা।নেই। পৃথিবী বদলাচ্ছে কিন্তু আমলারা আর আচরণ বদলাতে চায় না। তারা তাদের সনাতনী পদ্ধতি অবলম্বন করে সব।কাজ করতে চায়।
৯. অধীনস্থ কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করা : আমলাদের আরেকটি আচরণগত সমস্যা হলো অধীনস্থ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে দুর্ব্যবহার করা। এটি এক ধরনের ব্যাধির মতো, যা অধীনস্থ কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির পথে।একটি বড় ধরনের অন্তরায়। বর্তমানে ব্যবস্থাপনার নতুন কৌশল সারা পৃথিবীতে ব্যবহার করা হচ্ছে কিন্তু তারা সেটি অনুসরণ না করে তাদের মতো করে ব্যবস্থাপনা করছে। মানব সম্পর্কের বিষয়টি মোটেই তাদের ব্যবস্থাপনায় স্থান পায় নি। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের সংকট সবসময় বিরাজ করছে।
১০.আপত্তি উত্থাপন করা : সকল বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করাও তাদের একটি আচরণগত সমস্যা। কোন বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সময় সে সম্পর্কে একটি নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে তা শুরু করা হয়। যেমন- কিছু কিছু শিক্ষক ছাত্রকে ফেল করানোর মানসিকতা নিয়ে খাতা দেখে থাকেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। অর্থাৎ সে বিষয়ে আপত্তি তার থাকবেই। এসব
আমলাদের কেবল নিজের বিদেশ ভ্রমণ, সন্তানের বৃত্তি প্রভৃতি ছাড়া আর সকল বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়।
১১. গণপ্রচেষ্টা বা উদ্যোগকে নস্যাৎ করা : আমলাদের আরেকটি লক্ষণীয় আচরণ হলো কোথাও কোন গণউদ্যোগ দেখলে সেটি নস্যাৎ করে দেয়ার প্রবল ইচ্ছা। সে ইচ্ছা তারা দু’ভাবে বাস্তবায়িত করেন। ১. হয় সেটিকে কোন মন্ত্রণালয়ের অধীন নিয়ে আসা, ২. সেটিকে আরো বেগবান করার জন্য কিছু অর্থ সাহায্য দিয়ে তাতে লোভ বা দুর্নীতি।প্রবেশ করিয়ে দেয়া। এভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত সে গণপ্রচেষ্টার বা গণউদ্যোগের অপমৃত্যু না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ ধরনের একটি আচরণ করে যাওয়া। বিশেষ করে শেষের কৌশলটি অবলম্বন করে নিজের কিছু স্বার্থ হাসিলের জন্য।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, ম্যাক্স ওয়েবার আমলাতন্ত্রকে দক্ষতাভিত্তিক প্রশাসন হিসেবে উল্লেখ করলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আমলাদের ভূমিকা জাতীয় উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন কর
ে। সাধারণত রাজনীতিবিদরা যদিও ক্ষমতায় থাকে কিন্তু প্রশাসনের সকল স্তরে থাকে আমলা যাদের ইচ্ছা ছাড়া কোনভাবেই কোন প্রকল্প প্রস্তুত, প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আমলাদের প্রতি সরকারের নমনীয় মনোভাবই এর অন্যতম কারণ।

ডিগ্রী অনার্স মাস্টার্স পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে পেতে Whatsapp এ ম্যাসেজ করুন। Whatsapp 01979786079