প্রাচীনকাল থেকে পূর্ব বাংলা রাজনৈতিকভাবে আলাদা বা স্বকীয় সত্তার অধিকারী ছিল—ব্যাখ্যা কর।

অথবা, প্রাচীন পূর্ব বাংলা ও বর্তমান বাংলাদেশের স্বকীয় সত্তা এক ও অভিন্ন-ব্যাখ্যা কর।
অথবা, আধুনিক বাংলাদেশের আলোকে প্রাচীন পূর্ব বাংলা রাজনৈতিকভাবে পশ্চিম বাংলা থেকে আলাদা ছিল কি না? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভৌগোলিকভাবে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা একটি অঞ্চল হলেও পূর্ব বাংলা সবসময় রাজনৈতিকভাবে আলাদা অস্তিত্বের অধিকারী ছিল। মৌর্য, গুপ্ত, পালদের মতো সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সময়ও পূর্ব বাংলা
তার রাজনৈতিক স্বকীয় সত্তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এর ফলে উত্তর ও পশ্চিম বাংলার সাথে পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক অনেক ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
পূর্ব বাংলার স্বকীয় সত্তা : দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় তথা সমতট ও বঙ্গ অঞ্চলে মৌর্য শাসন বিস্তারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আদিকাল থেকে বাংলায় কোনো একক রাজনৈতিক সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। প্রাচীনকালে এ অঞ্চল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। নদী এ বিভক্তিতে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে।
সাম্রাজ্যবাদী মৌর্যরা পূর্ব বাংলায় তাদের শাসন বিস্তার করতে পারেনি। মৌর্য পরবর্তী সময়ে গুপ্তরা পূর্ব বাংলা করদ রাজ্য হিসেবে শাসন করে কিছু দিনের জন্য। কিন্তু এটা দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। গুপ্ত পরবর্তী সময় সেন বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত সময়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা পৃথক রাজনৈতিক অস্তিত্বের
অধিকারে ছিল। গত দুই তিন দশকে যেসব উৎস আবিষ্কৃত হয়েছে তার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার স্বকীয়তা অনেক স্পষ্ট। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক স্বকীয় সত্তাই পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে উৎসাহিত করে।
গুপ্তদের সময়ে পূর্ব বাংলার অবস্থা : সাম্রাজ্যবাদী গুপ্তরা যখন উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় শাসন করে তখন দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় কয়জন স্বাধীন রাজার নাম পাওয়া যায়। পূর্ব বাংলায় প্রাপ্ত ৭টি তাম্রশাসনে এদের বিবরণ পাওয়া যায়।
এরা হলো : ১. ধর্মাদিত্য, ২. গোপচন্দ্র এবং ৩. সমাচার দেব। এ তিনজন রাজা ছিলেন সার্বভৌম, তাদের নামে তাম্রশাসন জারি করা হয় এবং তারা পূর্ব বাংলার স্বাধীন রাজা
ছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে যখন পরবর্তী গুপ্ত বংশীয়রা গৌড় ও মগধে শাসন করে তখন দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় খড়গ
বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। কুমিল্লার দেব পর্বতে তাদের রাজধানী ছিল বলে বিভিন্ন উৎসে পাওয়া যায়। অষ্টম শতকে সমতট ‘দেব’ রাজবংশ সমতট অঞ্চলে স্বাধীনভাবে শাসন করে। শান্তিদেব, বীরদেব, আনন্দদেব ও
ভবদেবের নাম বিভিন্ন তাম্রলিপিতে পাওয়া যায়। এরা সকলে এ অঞ্চলের স্বাধীন রাজা ছিলেন এবং তাদের রাজধানী ছিল দেব পর্বতে।
চন্দ্র শাসন : নবম শতকের শেষ থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত সময়ে এ অঞ্চলে চন্দ্র রাজবংশ শাসন করে। এ বংশের ক’জন বিখ্যাত রাজা হলেন-
১. ত্রৈলোক্য চন্দ্ৰ,
৩. কল্যাণচন্দ্র,
৫. গোবিন্দচন্দ্ৰ।
এরা সকলে স্বাধীন রাজা ছিলেন এবং বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপন করে পূর্ব বাংলা স্বাধীনভাবে শাসন করেন। এ দীর্ঘ সময় ভৌগোলিকভাবে একই এলাকা হওয়ার পরও উত্তর ও পশ্চিম বাংলা রাজনৈতিকভাবে পৃথক ছিল । চন্দ্রদের পরে বর্মণ রাজবংশ পূর্ব বাংলা শাসন করে। সেনদের সময় বিজয় সেন অল্প কিছুদিনের জন্য সমগ্র বাংলা একক শাসনে আনয়ন করেন।
২. শ্রীচন্দ্ৰ,
৪. লড়হচন্দ্র ও
পালদের শাসনের সময় এ পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আলাদা অস্তিত্ব ছিল। অনেক ঐতিহাসিক বলেন, পালরা কিছু সময়ের জন্য বাংলায় শাসন করে, কিন্তু এর ফল দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। পূর্ব বাংলার এ পৃথক রাজনৈতিক সত্তার অবস্থিতি বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ কারণে উত্তর ও পশ্চিম বাংলার সাথে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিগত অনেক পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন থেকে পূর্ব বাংলা পৃথক রাজনৈতিক সত্তার অধিকারী হয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে।
এ ব্যক্তিত্ব পরবর্তীতেও বিলীন হয়ে যায়নি। এর শাশ্বত রূপ পরবর্তী যুগেও অনুভূত হয়।
ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি হলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয় পূর্ব বাংলাকে। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করে পূর্ব বাংলা ১৯৭১ সালে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা অর্জন করে তার স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। যদিও বাংলা বিজ্ঞপ্তি নিয়ে অনেক পণ্ডিত বিরাগভাজন হলো। তথাপি বাংলার এ রাজনৈতিক বিভক্ত সুপ্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে যা উপরের আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত। এভাবেই পূর্ব বাংলা তার প্রাচীনত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় আলাদা রাজনৈতিক অস্তিত্ব হওয়ায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এর অন্যতম ফল হলো অনার্য প্রভাব ধরে রাখা। পূর্ব বাংলায় আলাদা রাজনৈতিক অস্তিত্ব থাকায় আর্যরা উত্তর ভারত থেকে বাংলায় আসতে প্রায় ১০০০ বছর সময় নেয়। ফলে এ সময়ে বাংলা তার
নিজস্বতাকে বিস্তারে সক্ষম হয়।