প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার সমাজকাঠামো সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার সমাজকাঠামো সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজ কাঠামো বলতে বুঝায় ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সম্পর্ককে যেমন- অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি মিলে সমাজ কাঠামো গড়ে উঠে। প্রাক ব্রিটিশ ভারতের সমাজ কাঠামো সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আলোচনা করা আবশ্যক।
প্রাক ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজ কাঠামো : প্রাক ব্রিটিশ ভারতের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। সেখানে ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রচলন ছিল না বললেই চলে। তৎকালীন ভারতীয় সমাজে ভূমিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানা বিদ্যমান ছিল এবং শাসনক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত ছিল। ফলে প্রাক ব্রিটিশ ভারতের একটা জটিল আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। আর আর্থিক ব্যবস্থার মৌলিক উপাদান ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সম্প্রদায়, যার ফলে এ গ্রামগুলোকে কেন্দ্র করেই অর্থনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালিত হতো, তাই ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসার ঘটে নি এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের সামন্তপ্রথা বিরাজমান ছিল । প্রাক ব্রিটিশ ভারতের সামাজিক কাঠামোর বিভিন্ন দিক এখানে আলোচনা করা হলো :
প্রাক ব্রিটিশ ভারতে ভূসম্পত্তিতে মালিকানা ব্যবস্থা : পৃথিবীর সর্বত্রই ভূমিকে মৌলিক সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রাক ব্রিটিশ ভারতের ভূমি মালিকানার প্রকৃতি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বার্নিয়ার তাঁর ‘Travels in the Mughal Empire’ গ্রন্থে বলেন, “রাজাই ছিলেন জমির মালিক।” তিনি কর্মচারীদেরকে বেতনের পরিবর্তে ভূমি বরাদ্দ দিতেন। অর্থাৎ রাজাই রাজ্যের সমুদয় সম্পত্তির মালিক।
২. স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সম্প্রদায় : ভারতীয় গ্রামগুলো ছিল ভারতবর্ষের আর্থিক ব্যবস্থার মৌলিক উপাদান। অধ্যাপক নাজমুল করিম মন্তব্য করেন যে, “গ্রামগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্ররূপে বিরাজ করতো। জীবনধারণে যা প্রয়োজন তার প্রায় সবকিছুই তারা নিজেরা জোগাড় করতো। বাইরের সাথে যোগাযোগের বিশেষ প্রয়োজন ছিল না। যেখানে কোনকিছুই টিকে থাকে না সেখানে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম নিজের জোরে টিকে গেছে। একের পর এক রাজবংশ এসেছে এবং লোপ পেয়েছে কিন্তু গ্রামীণ সমাজ মূলত একই থেকে গেছে।”
৩. সামন্তপ্রথা : প্রাক ব্রিটিশ আমলের ভারতীয় সমাজের গঠন সামন্ততান্ত্রিক ছিল বলে অধ্যাপক নাজমুল করিম মন্তব্য করেন। কিন্তু জলবায়ু, ভূমি ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রকৃতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো ইত্যাদি কারণে ভারতে পাশ্চাত্যের ন্যায় সামন্ততন্ত্রের বিকাশ ঘটে নি। ভারতীয় সামন্তপ্রথায় ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। তাই কোন অভিজাত শ্রেণ তথা মালিক শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল না। নাজমুল করিম ভারতীয় সামন্তপ্রথার তিনটি শ্রেণির কথা বলেন, যথাঃ ক. কৃষক শ্রেণি, খ. খাজনা আদায়কারী শ্রেণি, গ. রাষ্ট্র, রাজা যার প্রতিনিধি ।
৪. কঠোর শ্রমবিভাজন : প্রাক ব্রিটিশ ভারতের গ্রামীণ কাঠামোর উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর শ্রমবিভাজন। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির প্রচলন ছিল কিন্তু অবসর সময় অন্যান্য কাজ করতো। তাদের উৎপাদনকার্যের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটানো। এছাড়াও কঠোর বর্ণবাদ শ্রমবিভাজনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
৫. কঠোর বর্ণাশ্রম প্রথা : ভারতীয় জাতিবর্ণ প্রথা গ্রামীণ সমাজকে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখতে কঠোর ভূমিকা পালন করেছে। কারণ জাতিবর্ণের লোকেরা জন্মসূত্রে বিভিন্ন পেশার অধিকারী হতো এবং এর পরিবর্তন সম্ভব ছিল না। এর ফলে উৎপাদিত দ্রব্য পণ্যে রূপ নেয় নি এবং মুক্তবাজার অর্থনীতিরও প্রচলন হয়নি
৬. মুদ্রা ও বি
নিময় ব্যবস্থা ও সীমিত বাজার ব্যবস্থা : প্রাক ব্রিটিশ ভারতীয় গ্রামীণ সমাজে মূলত বিনিময় ব্যবস্থার প্রচলন ছিল । আবার দেনা পাওনা মিটানোর ক্ষেত্রেও কৃষিজ দ্রব্যাদি বিনিময়ের প্রথা প্রচলিত ছিল। প্রয়োজনীয় দ্রব্য গ্রামের মানুষেরা উৎপাদন করলেও লবণ, কেরোসিন ইত্যাদি আমদানি করতে হতো তাও বিনিময়ের মাধ্যমে পরিশোধ করা হতো। তবে খাজনা দেয়ার কাজে সীমিত পরিসরে মুদ্রা অর্থনীতির প্রচলন ছিল বলে অনেকে মন্তব্য করেন।
৭. অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা : প্রাক ব্রিটিশ ভারতের গ্রামগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রকৃতির অর্থাৎ জনসাধারণের প্রয়োজনীয় সবকিছু গ্রামেই উৎপাদিত হতো। তাই বহির্বিশ্ব থেকে কিছু আনার প্রয়োজন হয় নি এ কারণে যানবাহনের উন্নয়ন ঘটে নি।
৮. জমি বণ্টনে গ্রাম কমিটির ভূমিকা : প্রাক ব্রিটিশ ভারতে ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা ছিল না, বরং ভূমির মালিক ছিল গ্রাম সম্প্রদায়। জমির ব্যবস্থাপনায় গ্রামের ভূমিকা ছিল স্বাধীন এবং খাজনার বিনিময়ে কৃষকরা জমি চাষ করতো স্বাধীনভাবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, প্রাক ব্রিটিশ ভারতে ব্যক্তি পুরোপুরি গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে ছিল । স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ সম্প্রদায় দ্বারাই তৎকালীন সমাজ কাঠামো সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়, যার কারণে অর্থব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা স্থবির ও অপরিবর্তনীয় ছিল ।