প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামো কেমন ছিল? আলোচনা কর।
অথবা, প্রাক-ব্রিটিশ আমলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার বিস্তারিত বিবরণ দাও।
অথবা, প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : প্রাক ব্রিটিশ বাংলার অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক ছিল । প্রাচীন বাংলায় কিছু শিল্প, রৌপ্য, তাম্র, লৌহ ইত্যাদি বিকাশ লাভ করলেও এগুলো ব্যাপকভিত্তিক বাণিজ্যিক পরিচিতি পায় নি। তাছাড়া প্রাচীন বাংলার মানুষের জীবন জীবিকার পুরোটাই জড়িয়ে ছিল কৃষি খামারের সাথে। তাছাড়া এখানে জমিদার ও বণিককেন্দ্রিক যে নগর জীবন গড়ে উঠেছিল, তা নির্ভরশীল ছিল কৃষি ব্যবস্থার উপর।
প্রাক ব্রিটিশ বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামো : যেহেতু প্রাক ব্রিটিশ বাংলার মানুষের সার্বিক জীবন কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল, তাই তাদের অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা পুরোপুরি কৃষি ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত হতো। সেজন্য প্রাক ব্রিটিশ বাংলায় জীবন ব্যবস্থার মধ্যে অর্থনৈতিক কাঠামো প্রধান আলোচ্যবিষয়। নিম্নে প্রাক ব্রিটিশ বাংলার অর্থনৈতিক
জীবন ব্যবস্থার কিছু দিক এখানে আলোচনা করা হলো :
১. স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সম্প্রদায় : ব্রিটিশ শাসনের আগ পর্যন্ত শতাব্দীকাল ধরে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামই ছিল ভারতবর্ষের আর্থিক ব্যবস্থায় মৌলিক উপাদান। ধর্মীয় আন্দোলন, রাজনৈতিক উত্থানপতন, বৈদেশিক শক্তির প্রভাব প্রভৃতি ঘাতপ্রতিঘাত সত্ত্বেও গ্রামীণ সম্প্রদায় ছিল অপরিবর্তনীয়। এখানে গ্রামগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্ররূপে বিরাজ করত। জীবনধারণে যা প্রয়োজন তার প্রায় সবকিছুই তারা নিজেরা জোগাড় করতে পারত।
২. ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানার অনুপস্থিতি : প্রাচীন বাংলায় রাষ্ট্রই জমির মালিক। জমিতে দাস, খেতমজুর ও কয়েদিদের শ্রম ব্যবহার করে উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হতো। অন্যদিকে, যারা উৎপাদনের সাথে জড়িত, তারা জমির মালিক ছিল না। অর্থাৎ উৎপাদক শ্রেণি জমির মালিক নয়, রাষ্ট্রই সর্বেসর্বা।
৩. সামন্ততান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা : ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য হলো ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানার অনুপস্থিতি। হিন্দু যুগে ভূমি সমগ্র গ্রাম সমাজের সম্পত্তি বলে বিবেচিত হতো, কখনো রাজার সম্পত্তি বলে গণ্য হতো না।
৪. কৃষিঋণ : বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতির কারণে বিপুল পরিমাণ ফসল ও সম্পদ নষ্ট হতো। তাই সাময়িক ক্ষতিপূরণের নিমিত্তে কৃষকগণ মহাজন, দোকানদার, আত্মীয়স্বজন বা ধনী কৃষকদের নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করতো। এমনকি তারা কর, খাজনা বা ব্যাংক ব্যবস্থা হতেও ঋণ গ্রহণ করতো।
৫. কৃষি শ্রমিক : ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলার কৃষিক্ষেত্রে সংগঠিত কোন শ্রমবাজার এবং মজুরি শ্রমের বিধান ছিল না। জোতদারগণ সাধারণত তাদের জমি বর্গাদারদের মধ্যে বণ্টন করে দিত। বর্গাচাষি ও ক্ষুদ্র চাষিরা নিজ পরিবারের সদস্যদের চাষের কাজে লাগত। অধিকন্তু কঠোরভাবে অনুসৃত পারস্পরিক বিনিময় প্রথায় শ্রম বিনিময় করা হতো। স্থানীয়ভাবে এসব শ্রম বদলা, গতি ইত্যাদি নামে পরিচিত। ১৮৪৩ সালে আইনের মাধ্যমে ক্রীতদাস প্রথা রহিত এবং মুদ্রা অর্থনীতির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে শ্রমিকদের ভাড়া খাটা বদলার জায়গা দখল করে নেয়।
শিল্প : প্রাক ব্রিটিশ বাংলার শিল্পকে প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যথা : ক. গ্রামীণ শিল্প, খ. নগর শিল্প । এখানে গ্রামীণ শিল্পের রূপকার হলো বিভিন্ন কারিগর শ্রেণি। যেমন- ছুতার, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে, মুচি ইত্যাদি। তখনকার সময় ছুতার ঘর নির্মাণ, গরু বা ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করতো। তুলা হতে সুতা এবং রেশমগুটি হতে রেশমি
সূতার কাপড় বানান তাঁতিরা। জামদানি মসলিন কাপড়ের চাদর বহির্বিশ্বে সমান সমাদৃত ছিল । কারিগরেরা প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন- কাঠ, মাটি, চামড়া, তুলা গ্রাম
থেকেই সংগ্রহ করতো। গ্রামীণ কৃষি ও কারিগরি শিল্পের কলাকৌশল খুব নিম্নমানের ছিল। কৃষি ও শিল্পনির্ভর গ্রাম জীবনে শতাব্দীর পর শতাব্দী কোন বৈচিত্র্য আসে নি। পর্যাপ্ত পরিমাণ যোগাযোগ ব্যবস্থার
অভাবে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিকাশ লাভ করতে পারে নি। প্রাক ব্রিটিশ ভারতের শহরগুলোতে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকাঠামো গড়ে উঠে। এগুলো গ্রামীণ শিল্পের তুলনায় উন্নতমানের। এ শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম যানবাহনের জন্য কাঠের বড় নৌকা, সুতি ও রেশমকার্ড, যা বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। ঢাকার মসলিনের দেশে বিদেশে অনেক চাহিদা ছিল। ধাতু ও পাথরের দ্রব্যসামগ্রী, চিনি, কাগজ শিল্প প্রভৃতি ছিল । এছাড়া কাঠের কাজ, মৃৎপাত্র ও চর্মশিল্প বিকাশ লাভ করে। খনিভিত্তিক শিল্প যেমন- দস্তা, পারদ ও লৌহকে ভিত্তি করে আর এক ধরনের শিল্প বিকাশ লাভ করে।
৭. শ্রমবিভাজন : প্রাক ব্রিটিশ ভারতের গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অপরিণত শ্রমবিভাজন। কৃষি ও শিল্পের পৃথকীকরণ বেশি অগ্রসর না হওয়া। Calverton এর মতে, “গ্রামীণ ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্য এই যে, অধিকাংশ কারিগরের কাজ ছিল সংক্ষিপ্ত গ্রামের প্রয়োজন মিটানো।” (A. R. Desai, P-10)
৮. প্রযুক্তি ও কৌশল : প্রাক ব্রিটিশ বাংলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মূলত গ্রামীণ ও শহরকেন্দ্রিক ছিল। অর্থনীতির দুটি ধারা কৃষি ও শিল্প, গ্রাম ও নগর জীবনকে সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত করে। গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দুটি দিক বিদ্যমান ছিল । একটি হলো প্রকৃতির বৃষ্টিনির্ভর এবং অন্যটি জল সেচভিত্তিক অর্থনীতি।
৯. রাজস্ব ব্যবস্থা : প্রাক ব্রিটিশ ভারতে অতীতকাল থেকে কৃষিজ ফসল বা উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর উপর হতে কর বা রাজস্ব আদায় করা হতো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে সাতটি স্থান হতে কর সংগ্রহের কথা উল্লেখ আছে। এগুলো হলো দুর্গবেষ্টিত নগরী, গ্রামাঞ্চল, খাল, সেচ, বর্ণ ও পশুপালন ও বাণিজ্য পথ। তবে পূজা, অর্চনা বা বলিদান কাজে নিয়োজিত ব্রাহ্মণকে উর্বর জমি চাষ করার জন্য দেয়া হতো। এ ধরনের ভূমি ব্যবস্থাকে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার ‘Brahminical Prebend’ বলে
আখ্যায়িত করেছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, ব্রিটিশ অধিকারের পূর্বে বহু শতাব্দী ধরে ব্যক্তি পুরোপুরিভাবে পরিবার ও গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে ছিল। অথচ সেখানে অর্থনৈতিক কাঠামো অনেকটাই জাতি, পরিবার ও গ্রাম পঞ্চায়েতের কারণে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বজায় ছিল, যার কারণে অর্থব্যবস্থা স্থবির, নিশ্চল ছিল ।