অথবা, তুমি কি মনে কর পূর্ব পাকিস্তান ছিল অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের একটি অঞ্চল? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের উপর শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সামরিক
শোষণ। যা ছিল একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ অঞ্চল সমতুল্য। দীর্ঘ ২৪ বছর যাবৎ পাকিস্তান সরকার নানাভাবে পূর্ব বাংলাকে শোষণ ও শাসন করতে থাকে। ভৌগোলিক ভাষা, সংস্কৃতিতে ছিল উভয় অঞ্চলের মধ্যে বিস্তর বিভেদ। পাকিস্তানি সরকার পূর্ব বাংলার উপর সামাজিক, সংস্কৃতিক ও ভাষাসহ অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং তাদের সিদ্ধান্তসমূহ জোর করে পূর্ব বাংলার উপর চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হয় যা উপনিবেশবাদের নামান্তর।
উপনিবেশবাদের সংজ্ঞা : ঔপনিবেশিক শক্তি কর্তৃক অন্য দেশের উপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিকতা বলা যায়। ঔপনিবেশিকতা হলো কোনো অঞ্চলের মানুষের উপর সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণকারী অন্য কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের শাসন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামরিক নিরাপত্তা এবং
অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য উপনিবেশ স্থাপন করা হয়েছে। যে শাসনব্যবস্থায় কোনো বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জোরপূর্বক একটি ভূখণ্ড বা সম্প্রদায়ের উপর রাজনৈতিক ক্ষমতা কঠোর দমননীতি স্থায়ীভাবে ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে সর্বোচ্চ শোষণের মাধ্যমে সে ভূখণ্ড বা সম্প্রদায়কে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরিয়ে রাখার নীতি হলো উপনিবেশবাদ ।
পূর্ব পাকিস্তান ছিল অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক একটি অঞ্চল : পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে দমন ও পীড়নের মাধ্যমে দীর্ঘ ২৪ বছর ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ করেছিল। নিচে পূর্ব পাকিস্তান ছিল অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক প্রদেশ বা একটি অঞ্চল তা বর্ণনা করা হলো :
১. রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো এবং সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিত। যেমন- পাকিস্তান গঠনের পর সীমানা কমিশন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বণ্টন প্রভৃতি ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ পূর্ব বাংলাকে উপেক্ষিত করতে থাকে। বেশিরভাগ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো পশ্চিম পাকিস্তানিদের অনুকূলে গৃহীত হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তান মূলত পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনে পরিণত হয়।
২. কেন্দ্র সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ : পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলা থেকে নিজেদের উচ্চ শ্রেণি মনে করতো। কেন্দ্রীয় সরকারের বেশিরভাগ নীতিনির্ধারক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। ফলে শাসকগোষ্ঠী তাদের ইচ্ছামতো ক্ষমতার অপব্যবহার করতো এবং তারা রাজনৈতিক শক্তিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের শক্তির ক্ষমতা প্রদর্শন করতো। যেমন ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে মুসলিম লীগের চক্রান্তে ১৯৫৪ সালে মে মাসে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়।
৩. পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ গড়ে তোলা : পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছিল ক্ষমতালোভী। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করতো। পূর্ব পাকিস্তান ছিল ধনসম্পদে পরিপূর্ণ। পূর্ব বাংলার সিংহভাগ রাজস্ব পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতো এবং পূর্ব বাংলার সম্পদে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পকলকারখানা প্রতিষ্ঠির হয়। যা পূর্ব পাকিস্তানকে ঔপনিবেশিক শাসনে পরিণত করে।
৪. সংস্কৃতি ধ্বংসের চক্রান্ত : পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনগোষ্ঠী শুরু থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য সংস্কৃতি ধ্বংসের চক্রান্ত শুরু করে। পাকিস্তানের ৫৬% লোকের ভাষা ছিল বাংলা অথচ মাত্র ৭% লোকের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার হীনচক্রান্ত গ্রহণ করে। যা পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়।
৫. পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা : পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে শিল্পকলকারখানা গড়ে তোলা হয়। ফলে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে যা পূর্ব বাংলাকে ঔপনিবেশিক অঞ্চলে পরিণত করে।
৬. সামরিক বৈষম্য : পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে পূর্ব বাংলাকে দমন করার নীতি গ্রহণ করে। স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুব খান থেকে শুরু করে ইয়াহিয়া খান পর্যন্ত সবাই বাংলার উপর সামরিক নির্যাতন শুরু করে। এছাড়া সামরিক বাহিনীতে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিত্ব ছিল নগণ্য। যা ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের নামান্তর।
৭. সম্পদ পাচার : পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে অনেক মূল্যবান দ্রব্য পাচার হতো। প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার মিলিয়নরুপি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতো। এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ১৯৪৮-৬৯ থেকে পর্যন্ত বিশ একুশ বছরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাচার করা হয় যা পাকিস্তানের উন্নয়নের ১৯ শতাংশ সম্পদ। যা ছিল অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ ।
৮. মুনাফা ও মূলধন ক্ষেত্রে শোষণ : পশ্চিম পাকিস্তানি কোন বিনিয়োগকারী তার ০% মূলধন দেখিয়ে ৯০% ঋণ সুবিধা পেত অথচ পূর্ব পাকিস্তানিদের এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হতো। পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত এবং সেখান থেকে রপ্তানি দ্রব্য পূর্ব প
াকিস্তানে আসত। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের লোকজন বৈষম্যের শিকার হতো । প্রধান প্রধান ব্যাংক, বিমা পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপিত হওয়ায় আর্থিক ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা ছিল উপেক্ষিত।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের উপর দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সর্বদিকে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতে থাকে বিভিন্ন কৌশলে। যা কার্যত ছিল ঔপনিবেশিক শাসন। কাজেই পূর্ব পাকিস্তান ছিল অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক একটি অঞ্চল।