পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে ভারতীয় দর্শনের পার্থক্য লিখ।
অথবা, পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে ভারতীয় দর্শনের বৈসাদৃশ্য লিখ।
অথবা, পাশ্চাত্য দর্শন কীভাবে ভারতীয় দর্শন থেকে পৃথক?
অথবা, পাশ্চাত্য দর্শন ও ভারতীয় দর্শনের মধ্যে কী কী অমিল খুঁজে পাওয়া যায়?
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতীয় দর্শন হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের জগৎ ও জীবন থেকে উদ্ভূত কতকগুলো মৌলিক সমস্যা ও এর যৌক্তিক অনুসন্ধান। জগৎ ও জীবনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে ভারতীয় মনীষিগণ যেসব তত্ত্ব ও মতবাদ প্রদান করেছেন তার সমষ্টিই ভারতীয় দর্শন। এজন্যই ভারতীয় দর্শনের পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত।
পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে ভারতীয় দর্শনের পার্থক্য : পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে ভারতীয় দর্শনের পার্থক্য নিম্নে আলোচনা করা হলো :
প্রথমত, ভারতীয় দর্শনের স্বরূপ আলোচনা করলে দেখা যায় যে, এখানে কেবল সত্যের জ্ঞানই নয়, বরং সত্য সাক্ষাৎ করাকেও আদর্শরূপে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে, পাশ্চাত্য দর্শনের স্বরূপ আলোচনা করলে দেখা যায় যে, এখানে কেবল সত্য জ্ঞান লাভই দার্শনিকদের সাধনা।
দ্বিতীয়ত, পাশ্চাত্য দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি সার্বিক, অন্যদিকে ভারতীয় দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি আংশিক।
তৃতীয়ত, ভারতীয় চিন্তাবিদরা ধর্ম ও দর্শনকে খুব একটা পৃথক করে দেখেন নি। এ কারণে গৌতম বুদ্ধ ও শ্রীকৃষ্ণ এরা ধর্মাবতারই নন, দার্শনিকও বটে। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনে ধর্ম ও দর্শনের খুব একটা সংযোগ লক্ষ্য করা যায় না।
চতুর্থত, ভারতীয় দর্শন বহিঃইন্দ্রিয়ের তুলনায় অন্তঃইন্দ্রিয়ের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। অন্যদিকে, পাশ্চাত্য দর্শনের সর্বত্র আন্তঃলৌকিক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায় না।
পঞ্চমত, ভারতীয় দার্শনিকদের কাছে দর্শনের সাথে ব্যবহারিক প্রয়োজনের সম্বন্ধ সরাসরি, জ্ঞানের সম্বন্ধ পরোক্ষ। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনের সর্বত্র ব্যবহারিক প্রয়োজনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয় নি। পাশ্চাত্য দর্শনে বুদ্ধির আলোকে সত্যের অনুসন্ধান করা হয়েছে।
ষষ্ঠত, ভারতবর্ষের মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষাই যাবতীয় দার্শনিক তত্ত্ব চিন্তার উৎস। অন্যদিকে, পাশ্চাত্য দর্শনে জ্ঞানের জ্ঞান চর্চা বা জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষাই যাবতীয় দার্শনিক চিন্তার উৎস।
সপ্তমত, ভারতীয় দর্শনে ক্রমবিকাশ আলোচনা করলে দেখা যায় যে, বিভিন্ন ভারতীয় দর্শনগুলো বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত হয়েও সুদীর্ঘকাল ধরে নিজ নিজ প্রভাবপ্রতিপত্তি বজায় রেখে পাশাপাশি চলছে। অন্যদিকে, পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সেখানে প্রধান প্রধান যেসব দার্শনিক মতবাদ গড়ে উঠেছিল সেগুলো একটির পর একটি আবির্ভূত হয়েছে।
অষ্টমত, ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায় পরিলক্ষিত হয়। যেমন- সাংখ্য, জৈন, বেদান্ত, ন্যায়, যোগ, মীমাংসা প্রভৃতি সম্প্রদায় রয়েছে। অন্যদিকে, পাশ্চাত্য দর্শনের ক্ষেত্রে আমরা এরূপ দার্শনিক সম্প্রদায় লক্ষ্য করি না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতীয় দর্শন একটা সর্বব্যাপক ও বিশাল ধারণা। ভারতীয় দর্শনে সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, জৈন প্রভৃতি দার্শনিক সম্প্রদায় আবির্ভূত হয়েছিল। অতি প্রাচীন হিন্দু দার্শনিক মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শন সংগ্রহ’ গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে ভারতীয় দর্শনের এ উদার এবং ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় দার্শনিকদের অপূর্ব সত্যানুসন্ধিসার ও বিচারনিষ্ঠার পরিচয় প্রদান করে।