General Knowledge

পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালের সামরিক সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালের সামরিক সরকার কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচিসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫৬ সালে প্রথম নিজেদের জন্য একটি শাসনতন্ত্র তৈরি করে। সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয়। কিন্তু সংসদীয় ব্যবস্থা
সঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ায় সেখানে চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুরু হয়। এ অচলাবস্থা মোকাবিলার জন্য প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহ ভেঙে দেয়া হয়। রাজনৈতিক দলসমূহ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। সামরিক শাসন জারি করে তারা জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, বেসামরিক সরকার অদক্ষ ও দুর্নীতিপ্রিয় ছিল।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর পদক্ষেপসমূহ : ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করেন এবং জেনারেল আইয়ুব খানকে CMLA নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালের ২৭
অক্টোবর আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। সামরিক সরকার কিছু জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি গ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেন। নিচে পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালের সামরিক সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. দক্ষ ও শ্রেষ্ঠ শাসন প্রমাণের পদক্ষেপ : পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর তারা জনসমর্থন সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আইয়ুব খান সামরিক বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। তারা যোগ্য, দক্ষ, দেশপ্রেমিক, আধুনিক রাষ্ট্রের কল্যাণে নিয়োজিত, আইয়ুব খান প্রথমত প্রচার করেন যে, পূর্ববর্তী নিয়মতান্ত্রিক সরকার দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে কেবল দেশকে রক্ষা করেনি বরং দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনের মাধ্যমে দেশকে শক্তিশালী করেছে।
২. দুর্নীতি প্রতিরোধ করা : তৎকালীন পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিমলীগ সরকার বিভিন্নভাবে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতার লড়াই, স্বার্থপরতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দেশপ্রেমের অভাব অধিকমাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। চোরাচালান, মজুদদারী, মুনাফাখোরি ইত্যাদির ফলে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সামরিক সরকার দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আটক করে। রাজনীতিবিদ বা দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষমতালোভী তা প্রমাণ করার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এবং ফিরোজ খান নূনকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।
৩. সামরিক আদেশ জারি : আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণের পর সামরিক আদেশ জারি করে রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী আমলাদেরকে অযোগ্য প্রমাণের চেষ্টা করেন। তিনি ১৫০ জন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, পার্লামেন্টারি, সেক্রেটারী এবং ৬০০ জন সাবেক প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন। EBDO এবং PODO জারি করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরকে কোনো নির্বাচিত সংস্থার সদস্য হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
৪. সামরিক পদসমূহ সুবিন্যস্ত করা : আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণের পর বেসামরিক প্রশাসকদের হেয় প্রতিপন্ন করেন। উচ্চপদস্থ বেসামরিক পদগুলোতে সামরিক বাহিনীর অফিসারদের নিয়োগ প্রদান করেন। এছাড়া পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের অনেক সদস্যকেও তিনি চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন। তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের ১৩ জন, ফরেন সার্ভিসের ৩ জন এবং পুলিশ সার্ভিসের ১৫ জন ও প্রাদেশিক সার্ভিসের মোট ১৬৬২ জন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেন অথবা বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করেন।
৫. গণমাধ্যমের উপর নিষ েধাজ্ঞা : আইয়ুব খান তার ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদি ও পাকাপোক্ত করতে সংবাদপত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। যেমন- ইত্তেফাক ও পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকাগুলো কালো তালিকাভুক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে মুনতাসির মামুন ও জয়ন্তকুমার রায় লিখেছেন, সামরিক শাসন প্রায়ই আঘাত হেনেছে সংবাদপত্রের উপর। কার্যত সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করে আইয়ুব খান নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে সচেষ্ট হয়।
৬. চোরাচালান প্রতিরোধ : সামরিক শাসক চোরাকারবারি নিষিদ্ধ করেন। চোরাকারবারিদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। চোরাকারবারি রোধ করার জন্য সীমান্ত এলাকায় পাহাড়া কড়াকড়ি করা হয়। আয়কর ফাকি প্রতিরোধ করা হয়। অবৈধ বৈদেশিক মুদ্রা সরকারের নিকট প্রচুর পরিমাণে জমা হয়।
৭. জনকল্যাণমূলক নীতি গ্রহণ : পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী জনগণের কল্যাণার্থে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করছে তা প্রমাণের জন্য আইয়ুব খান বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করেন। দ্রব্যমূল্যের দাম নির্ধারণ, সারাদেশে সামরিক আইন আদালত স্থাপন, বিশহাজার পরিবারকে পুনর্বাসিত করা প্রভৃতি পদক্ষেপ দ্বারা জনগণের সমর্থন লাভের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন।
৮. সামরিক বাহিনী আধুনিকায়ন : আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণের পর সামরিক বাহিনী যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণের চেষ্টা করেন। সামরিক বাহিনী একটি আধুনিক ও সুশৃঙ্খল বাহিনী যারা দেশের উন্নয়ন ও দেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা জনসম্মুখে প্রচার করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ একটি সাধারণ ঘটনা। বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানে সামরিক শাসন থাকায় সেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুদৃঢ় হতে পারেনি। যদিও সামরিক বাহিনী
জনকল্যাণমূলক নীতি ঘোষণা করে কিন্তু বাস্তবায়ন করে নিজেদের স্বার্থে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!