পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অধীনে প্রবর্তিত পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থার স্বরূপ আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৫৬ সালের সংবিধানের স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ১৯৫৬ সালে প্রণীত সংবিধানের পটভূমিসহ এর প্রকৃতি আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সংবিধান হলো যে কোনো দেশ বা জাতির রাষ্ট্রীয় জীবনের চলার পাথেয়। সংবিধানবিহীন রাষ্ট্র কর্ণধারবিহীন জাহাজের সমতুল্য। বাংলাদেশ ও পাক-ভারতের ইতিহাসে ‘৪৭ সালের পরবর্তীতে একটি গ্রহণযোগ্য সংবিধান প্রণয়নের জন্য একাধিকবার দাবি উত্থাপিত হয়। কিন্তু কোনো দাবিতে কাজ হয়নি। তাই ১৯৫৪ এর নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাকিস্তানের গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে এ সংবিধানের খসড়া প্রস্তাব করা হয়। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ এটা কার্যকর হয়। এটাই পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধান নামে অভিহিত।
১৯৫৬ সালের সংবিধানের অধীনে সংসদীয় ব্যবস্থার স্বরূপ : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের দিকে লক্ষ -করলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ করা যায়। যথা :
১. মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অধীনে সর্বপ্রথম সংসদীয় তথা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ব্রিটিশ সংবিধানের ন্যায় এ সংবিধানেও আইন পরিষদের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়। কেন্দ্র ও প্রদেশ উভয় ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। কেন্দ্রে প্রেসিডেন্ট এবং প্রদেশে প্রাদেশিক গভর্নর ছিলেন সাংবিধানিক প্রধান। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ জাতীয় পরিষদের কাছে এবং প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদ প্রাদেশিক আইন পরিষদের কাছে দায়ী ছিলেন। আইন পরিষদে কোনো অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হলে মন্ত্রিপরিষদকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হতো।
২. প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিপরিষদের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা : পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিপরিষদের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করতেন। তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্টের প্রধান পরামর্শদাতা এবং তিনি সকল কার্য পরিচালনা করতেন। সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের হাতে যে ব্যাপক ক্ষমতা অর্পিত হয়েছিল কার্যত তা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে পরিচালিত হতো। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সুশাসন অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল প্রধানমন্ত্রীর যোগ্যতা, দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব এবং জনপ্রিয়তার উপর।
৩. প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার পরিধি বৃদ্ধি : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলেও প্রকৃত ক্ষমতা ছিল প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদের হাতে। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কার্যত শাসকপ্রধান। তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
৪. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগবিধি : ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে অবশ্যই তা প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ বিধি ছিল অনেকটা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ব্যবস্থার অনুরূপ।
৫. প্রেসিডেন্ট নিয়মতান্ত্রিক প্রধান : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারব্যবস্থা গৃহীত হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান মাত্র। প্রেসিডেন্ট মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। সংবিধান লঙ্ঘন, মারাত্মক অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে তাকে অপসারণ করা যেত। জাতীয় পরিষদের মোট সদস্যের এক- তৃতীয়াংশের মাধ্যমে এ অভিযোগ প্রস্তাব আনয়ন করা যেত এবং তিন-চতুর্থাংশ সদস্য কর্তৃক গৃহীত হলে উক্ত প্রস্তাব কার্যকর হতো।
৬. প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নির্ধার
ণ : ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট যদিও নিয়মতান্ত্রিক প্রধান ছিলেন, তবুও তাঁর যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল। শাসন সংক্রান্ত, আইন সংক্রান্ত, বিচার সংক্রান্ত ও অর্থ সংক্রান্ত বিশেষ সুযোগ সুবিধা ভোগ করার পরও তিনি জরুরি অবস্থায় বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারতেন। প্রাদেশিক শাসন ও আইন সংক্রান্ত বিষয়েও তিনি যথেষ্ট ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারতেন।
৭. জাতীয় পরিষদ গঠন : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অধীনে প্রেসিডেন্ট ও এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা নিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ গঠিত হয়। ৩০০ জন সদস্য নিয়ে জাতীয় পরিষদ গঠিত ছিল। এর মধ্যে ১৫০ জন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এবং ১৫০ জন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হতেন। জাতীয় পরিষদের কার্যকাল ছিল পাঁচ বছর। প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান, স্থগিত কিংবা ভেঙে দিতে পারতেন।
৮. জাতীয় পরিষদের কর্তৃত্ব নির্ধারণ : পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদকে আইন প্রণয়ন, অর্থ সংক্রান্ত ও শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। জাতীয় পরিষদ সমগ্র পাকিস্তানের জন্য অথবা এর যে কোনো অংশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় তালিকাভুক্ত যে কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারত। জাতীয় পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত যে কোনো বিল প্রেসিডেন্টের সম্মতি ছাড়া আইনে পরিণত হতে পারত না। অনেক ক্ষেত্রে অর্থ তহবিলের রক্ষক ও নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবেও জাতীয় পরিষদ কাজ করতো।
৯. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ সরকার গঠনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এ সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রায় সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করে দেওয়া হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় সহস্রাধিক মাইলের ব্যবধান হলেও কোনো শাসনতান্ত্রিক তেমন অসুবিধা হয়নি।
১০. মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের মাধ্যমে প্রদেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে গভর্নর নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। গভর্নরের নামেই প্রাদেশিক শাসনকার্য পরিচালিত হতো। গভর্নর প্রেসিডেন্টের ইচ্ছানুসারে নিযুক্ত হতেন এবং স্বীয় পদে বহাল থাকতেন। তার কার্যকাল ছিল পাঁচ বছর। প্রাদেশিক গভর্নর শাসন, আইন ও অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা ভোগ করতেন।
১১. প্রাদেশিক আইনসভা গঠন : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রাদেশিক গভর্নর ও এককক্ষবিশিষ্ট পরিষদ নিয়ে প্রাদেশিক আইনসভা গঠন করা হয়। এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০০ জন। আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা, অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা এবং মন্ত্রিসভার উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কার্যকর করতো প্রাদেশিক আইনসভা।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। যা ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু এ সংসদীয় ব্যবস্থা পাকিস্তানে কার্যকর হতে পারেনি।