উত্তর৷ ভূমিকা : সংবিধান রাষ্ট্রপরিচালনার মূল দর্পণস্বরূপ। পাকিস্তানের ১৯৬২ সালের সংবিধান সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় প্রণয়ন ও প্রবর্তন করা হয়। এ সংবিধান জেনারেল আইয়ুব খানের মস্তিষ্কপ্রসূত। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা দেশে সামরিক আইন জারি করেন। তিনি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত করেন এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল ঘোষণা করেন। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নতুন সংবিধান ঘোষণা করেন, যা ১৯৬২ সালের সংবিধান নামে পরিচিত।
১৯৬২ সালের সংবিধান একটি সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের দলিল : জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৬২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করেন তাকে স্বৈরতন্ত্রের দলিল বলে অভিহিত করা হয়। নিচে এ উক্তিটির যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করা হলো :
১. সংবিধান কমিশন গঠন : সংবিধান কমিশন কোন নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হয়নি। প্রেসিডেন্টের খেয়ালখুশিমতো এ কমিশন গঠিত হয়েছিল। এ কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ অগ্রাহ্য করে প্রেসিডেন্ট তাঁর পছন্দমতো ধারা সংযোজন করেন এবং ১৯৬২ সালের ১ মার্চ তারিখে সংবিধান ঘোষণা করেন। এতে প্রেসিডেন্টের স্বৈরাচারী আচরণের পরিচয় পাওয়া যায়। স্বৈরাচারের মাধ্যমে যে সংবিধানের জন্ম, সে সংবিধান স্বৈরাচারই জন্ম দেবে এটাই স্বাভাবিক। যে কারণে ১৯৬২ সালের সংবিধানকে স্বৈরতন্ত্রের নীল নকশা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
২. প্রেসিডেন্ট নির্বাচন : প্রেসিডেন্টের আশীর্বাদপুষ্ট ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটি নিঃসন্দেহে সংবিধানের একটি স্বৈরতান্ত্রিক ধারা। ফলে ১৯৬২ সালের সংবিধানকে স্বৈরতন্ত্রের দলিল বললে খুব বেশি অত্যুক্তি হবে না।
৩. মৌলিক অধিকারের সংকুচিতকরণ : ১৯৬২ সালের সংবিধানে আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য কোন মৌলিক অধিকারের উল্লেখ ছিল না, যা স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের একটি উত্তম পন্থা। অবশ্য সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ১৯৬৩ সালে মৌলিক অধিকার সংযোজন করা হলেও বিভিন্নভাবে তা খর্ব করা যেত, যে কারণে ১৯৬২ সালের সংবিধানকে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের দলিল হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়।
৪. প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি : ১৯৬২ সালের সংবিধানের অধীনে প্রেসিডেন্টের যাবতীয় ক্ষমতা অস্বাভাবিকরূপে বৃদ্ধি করা হয়। সংসদের ক্ষমতা ক্ষুণ্ন করে এক একটি ‘বিতর্ক সভায়’ পরিণত করা হয়। প্রেসিডেন্ট তাঁর পছন্দমতো মন্ত্রী নিয়োগ করতেন এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তিনি মন্ত্রীদেরকে বরখাস্ত করতে পারতেন। প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করার যে
ব্যবস্থা ছিল তা ছিল অত্যন্ত কঠিন। সরকারের কোন দায়িত্বশীলতা ছিল না। প্রেসিডেন্টের মতে সায় দেওয়া ছিল বিভিন্ন বিভাগের প্রধান কাজ। প্রেসিডেন্টকে স্বৈরাচারী করার সব ব্যবস্থা এ সংবিধানে নেয়া হয়েছিল।
৫. বিচার বিভাগের উপর শাসন বিভাগের প্রভাব : ১৯৬২ সালের সংবিধানের অধীনে বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে শাসন বিভাগের যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান ছিল, যার ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অনেকাংশে ক্ষুণ্ন হয়েছিল এবং জনগণও অনেক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতো। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার এটি একটি লক্ষণ হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়।
৬. জরুরি অবস্থায় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা : যুদ্ধ বা বৈদেশিক আক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে পাকিস্তান বা এর কোন অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা গুরুতর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলে প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সমুদয় ক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করতে পারতেন। জরুরি অবস্থায় প্রেসিডেন্ট প্রকৃতপক্ষে একজন
স্বৈরশাসকের ক্ষমতা ভোগ করতেন ।
৭. অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা : অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে সংবিধান প্রেসিডেন্টের হাতে অগাধ ক্ষমতা ন্যস্ত করেছিল। তাঁর সুপারিশ ছাড়া কোন অর্থবিল বা ব্যয় বরাদ্দের দাবি জাতীয় পরিষদে পেশ করা যেতো না। অতিরিক্ত আর্থিক মঞ্জুরির ব্যাপারেও তাঁর ক্ষমতা ছিল অসীম। তাই এ ধরনের ক্ষমতার অধিকারীকে স্বৈরতন্ত্রের সামিল ছাড়া আর
কিছুই বলা যায় না।
৮. সংবিধান সংশোধন ক্ষমতা : ১৯৬২ সালের সংবিধান যেমন প্রেসিডেন্টের ইচ্ছানুযায়ী প্রণীত হয়েছে এবং এ সংবিধানের ব্যাপারেও প্রেসিডেন্টের প্রভাব ছিল অপরিসীম। তিনি নিজ স্বার্থে প্রয়োজনমতো যাতে সংবিধান সহজেই সংশোধন করতে পারেন, সংবিধানে সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।’
৯. মৌলিক গণতন্ত্র : ১৯৬২ সালের আইয়ুব সংবিধানে আইয়ুব সৃষ্ট পরোক্ষ নির্বাচন সংবলিত মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছিল, সেটা ছিল স্বৈরশাসনের নীলনকশাস্বরূপ।
১০. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব : ১৯৬২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করা হয়। কোন আইন বা অসাংবিধানিক ঘোষণার ক্ষমতা বিচার বিভাগের ছিল না। অথচ ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়নি, যে কারণে ১৯৬২ সালের সংবিধানকে স্বৈরশাসনের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
১১. ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির অভাব : ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের কোন প্রাধান্য ছিল না। ফলে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির ভিত্তি গড়ে উঠতে পারেনি। তাই শাসন বিভাগ আইন ও বিচার বিভাগের অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করতো।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, মূলত পাকিস্তানের ১৯৬২ এর সংবিধান যে কার্যত একটি সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের দলিল ছিল এতে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। এ সংবিধানেই স্বৈরাচারীভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও কমিশন গঠনের কথা উল্লেখ আছে। অযথা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হলেও এতে কোন মৌলিক অধিকারের কথা সন্নিবেশিত নেই।

admin

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!