অথবা, পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের গুরুত্ব বর্ণনা কর।
অথবা, পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব পর্যালোচনা কর।
উত্তরায় ভূমিকা :
পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের প্রভাব ও গুরুত্ব সুদৃঢ়ভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। জাতি গঠনের প্রাথমিক স্তরে সামরিক বেসামরিক আমলারা বার বার ঘুরেফিরে জাতীয় রাজনীতিসহ বিভিন্ন গুরুতপূর্ণ ক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে পাকিস্তানের
শাসনতান্ত্রিক ঐতিহ্য সুবিধাজনকভাবে গড়ে ওঠেনি। পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামরিক ও বেসামরিক আমলাগণ আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। সামরিক আমলাগণ সুযোগ পেলেই শাসনতান্ত্রিক কাঠামোসহ রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ ও রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছিল।
পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের প্রভাব : পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের প্রভাব নতুন কোনো ঘটনা নয়। রাজনৈতিক কারণে রাজনৈতিক অনৈক্য, দুর্নীতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। নিচে তা ব্যাখ্যা করা হলো :
১. পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস : ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হলে মুসলমান ‘ICS’ অফিসারদের এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন পাঞ্জাবি, অবশিষ্টরা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আগত অবাঙালি রিফিউজি মুসলমান। আর এদের নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস। এরা মূলত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানপন্থি। ফলে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে অবাঙালি মুসলমানদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করেছিল। যার ফলে আমলাতান্ত্রিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সুবিধাজনকভাবে অবস্থান করেছিল।
২. পাঞ্জাবিদের প্রাধান্য : পাকিস্তান শাসনামলে পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে পাঞ্জাবিদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল অপ্রতিরোধ্য। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকাংশ নিয়ন্ত্রিত হতো পাঞ্জাবির হাতে। প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান মানসিকভাবে আমলা স্বভাবের ছিলেন, কিন্তু পাঞ্জাবি ছিলেন না। যে জন্য তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের মধ্যে ছিল সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক। পশ্চিম পাকিস্তানি আমলারা নিজেদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো।
৩. সুশৃঙ্খল সামরিক আমলাতন্ত্র : পাকিস্তান ব্রিটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে এক সুশৃঙ্খল আমলাগোষ্ঠী লাভ করে। পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র ছিল প্রশাসনের সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। দেশে শান্তি, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাসহ সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ততা বজায় রাখত, কিন্তু এ আমলাশ্রেণিতে পূর্ব বাংলার তেমন প্রতিনিধিত্ব ছিল না ।
৪. সুসংহত আমলাতন্ত্র : পাকিস্তানে সামরিক ও বেসামরিক আমলাগণদের সমন্বয়ে একটি সুসংহত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এক গবেষণায় দেখা যায় যে, পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীতে ২২ বছরের মধ্যে কোনো বাঙালি মেজর জেনারেল কিংবা সমমর্যাদার অফিসার কোনো পদে আসীন হতে পারেনি।
৫. প্রশাসনে অবাঙালি আধিপত্য : পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের প্রভাব ছিল বেশি। ফলে পূর্ব বাংলার স্বার্থ অধিকাংশ সময় উপেক্ষিত হতো। ১৯৪৭ সালে ৯৪ জন অবাঙালি মুসলমান ‘ICS’ অফিসার ছিল, এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। সকল গুরুত্বপূর্ণ পদ ছিল তাদের দখলে।
৬. মদ্রিত্ব গ্রহণ : আইয়ুব খানের অধীনে ১৬ জন বাঙালি মন্ত্রিত্ব করেন। তাঁর মধ্যে ৪ জন ছিলেন প্রাক্তন আমলা ও একজন সাংবাদিক অবশিষ্ট ১১ জন ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা যাদের ৮ জনই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পরাজিত ব্যক্তি। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের চেতনা ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটেনি J
নীতিনির্ধারণ : পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত, সরকারের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সামরিক ও বেসামরিক আমলাগণ মুখ্য ভূমিকা পালন করতো। ১৯৬৪ সালে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের মোট ১৭ জন সচিবের মধ্যে মাত্র ২ জন ছিলেন বাঙালি। সচিবালয়ের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের মধ্যে ও বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল মাত্র ২১%। ১৯৬৬ সালে মোট ৮০১ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র ১৭০ জন বাঙালি ছিলেন। ১৯৬৫ সালের দিকে কেন্দ্রীয় চাকরিতে সঠিকভাবে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল ২৪%। কার্যত পূর্ব বাংলার জনগণের নীতিনির্ধারণে তেমন কোনো অংশ ছিল না।
সামরিক প্রতিষ্ঠান ও রিক্রুটিং এজেন্সিতে পশ্চিমাদের আধিপত্য : সামরিক প্রতিষ্ঠান ও রিক্রুটিং এজেন্সিতে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য ছিল একচেটিয়া। প্রতিরক্ষা বিভাগের সকল শাখার সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রতিরক্ষা ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলোও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সহসা বাঙালিদের অফিসার পদে নিয়োগ দিত না।
জাতি গঠনে প্রাধান্য : জাতি গঠনে প্রাধান্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের। রাজনীতিবিদদের পরিবর্তে আমলারা জাতি গঠনে মূল দায়িত্ব পালন করতে থাকে। যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব তেমন ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের সরকারি তোষামোদ : পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের তোষামোদ করতো। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যেহেতু বাঙালিদের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত সে কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিজেদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো।
বিদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের প্রভাব : বিদেশি মিশনগুলোতে ৮৫% কর্মচারী ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের আর ১৫% ছিল পূর্ব পাকিস্তানি। ৬৯ জন রাষ্ট্রদূতের মধ্যে ৬০ জন দূত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাগণ দ্বারা পূর্ব পাকিস্তান শোষিত হতো। অধিকাংশ নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পশ্চিম পাকিস্তানি স্বার্থ রক্ষিত হতো। সর্বক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান পিছিয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের আধিপত্য ও দৌরাত্ম্যের কারণে

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%be/
admin

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!