পশ্চিম পাকিস্তান শাসক চক্র কর্তৃক পূর্ব বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ কৌশলগুলো আলোচনা কর।
অথবা, পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক মহলের কৌশলগুলো কী কী?
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান রাষ্ট্র দুটি আলাদা ভূখণ্ডে বিভক্ত ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে বিভক্ত ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন নেতিবাচক কৌশল অবলম্বন করেছিল। দুই পাকিস্তানের মধ্যে এ বৈষম্যমূলক আচরণের জন্যই ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।
পূর্ব বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ ও বৈষম্যমূলক আচরণসমূহ : পূর্ব বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে সকল নিয়ন্ত্রণমূলক ও বৈষম্যমূলক আচরণ গ্রহণ করেছিল নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো :
১. ভাষা : পূর্ব বাংলাকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রধান ও প্রথম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয় ভাষা। কারণ পূর্ব বাংলার জনগণ উর্দু ভাষায় দুর্বল ছিল তাই তারা চাকরির ক্ষেত্র থেকে বিভিন্নভাবে পিছিয়ে পড়ত। তাছাড়া বাংলা ও উর্দু ভাষাকে আরবি ভাষায় রূপান্তরের কথাও ঘোষণা করা হয়। জিন্নাহ বলেন উর্দু হলো উচ্চ শ্রেণির ভাষা, তাই উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা । ফলে ভাষাগত কৌশল খাঁটিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার মানুষকে দমিয়ে রাখার এবং শাসন ও শোষণের পাঁয়তারা করেছিল।
২. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা ভূখণ্ড হওয়ায় এদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা, আচারব্যবহার ও ঐতিহ্যগত বিরোধ ছিল বিরাট। এজন্য দুই পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ ও আন্দোলন ছিল পাকিস্তানি শাসনামলের ২৪ বছরে। সিন্ধু, বেলুচিস্তান আর পাঞ্জাবিদের মধ্যে পাঞ্জাবিদের প্রাধান্য ছিল বেশি।
৩. সামরিক ক্ষেত্রে বৈষম্য : ১৯৪৭ সাল হতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে যে নিয়োগ হয়, তাতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে ছিল ৯৫% ভাগ। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে ভীষণভাবে বঞ্চিত করা হয়। সে সময় আইয়ুব খান যে শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে তা ছিল কার্যত ‘সাংবিধানিক একনায়কত্ব’। আইয়ুব আমলে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ সীমিত
থাকার কারণে নীতিনির্ধারণে আমলারা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আমলাবাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল নগণ্য।
৭. মূল্যবোধগত পার্থক্য : পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়গোষ্ঠী মূলত বাংলাদেশের মুসলমানদের বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখে যে, পূর্ব পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে ভারতের দালালি করছে। কারণ বাংলাদেশের মুসলমানরা হিন্দু বাংলার সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট, হিন্দু রবীন্দ্রনাথের ভক্ত, নিজস্ব জীবনবোধ ও সংস্কৃতির প্রতি অধিকতর
শ্রদ্ধাশীল এবং মুসলিমদের ভাষা উর্দু অপেক্ষা বাংলার প্রতি অনুরক্ত।
৮. কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবহেলা : পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতায় উভয় অংশের মধ্যে একাত্মতা স্থাপনের কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি, বরং জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার মনোভাব গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভারত বিদ্বেষী মনোভাব জাগ্রত করার প্রচেষ্টা করছে সবসময়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতি সন্দেহপরায়ণ হয়ে তাই প্রথম থেকে বাংলাদেশে এক বিজাতীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে।
৯. ভঙ্গুর মনোভাব : বাঙালিরা ‘পুরাপুরি মুসলমান নয়’ এ মনোভাবের ফলে পাকিস্তানের মৌলিক আদর্শে বাঙালিরা কোনদিন একাত্মতা অনুভব করেনি। বাঙালিরা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসে। বাঙালিরা ধর্মকে ভালোবাসে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাসে বাঙালির
া কোন দিন ‘প্রকৃত বাঙালি’ হয়ে প্রকৃত পাকিস্তানি হবার সুযোগ লাভ করেনি। এমনকি ১৯৭১ সালের সংগ্রামী দিনগুলোতেও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুসলমানদের হত্যা করে ‘বিধর্মী’ হত্যার অপার আনন্দ অনুভব করেছিল।
১০. রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা : পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবাস্তব পরিকল্পনা, পাকিস্তানে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রচলন ও কেন্দ্রকে শক্তিশালী করতে দৃঢ় সংকল্প পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী প্রথম থেকে চেষ্টা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে। প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থাকে কেন্দ্রের অধীনে ন্যস্ত করতে এবং কেন্দ্রে এক প্রকার একনায়কসুলভ শক্তিকেন্দ্র স্থাপন করতে। তা একদিকে যেমন ছিল ইতিহাসের গতিধারা বিরোধী, অন্যদিকে তেমন ভৌগোলিক অবস্থানের সঠিক অনুধাবনহীনতা। খাজা
নাজিমউদ্দিন ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, লোভী ও ষড়যন্ত্রকারী। তার আমলেই পাকিস্তানে ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্র’ শুরু হয়।
১১. উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগ বৈষম্য : স্থায়ী কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হবার ফলে বাংলাদেশের সমূহ ক্ষতি হলো। কেননা বাংলাদেশ থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত পর্যায়ে কোন দিনই কোন বাঙালি কর্মচারী সুযোগ লাভ করেনি।
১২. সংখ্যাধিক্য নীতি না মানা : কেন্দ্রীয় সরকারে বাংলাদেশ থেকে সমান সংখ্যক মন্ত্রী নিযুক্ত হলেও গণপরিষদে বাংলাদেশ থেকে অধিক সংখ্যক সদস্য থাকা সত্ত্বেও তাঁরা পূর্ব বাংলার স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। কেননা তাদের ক্ষমতা ছিল সীমিত এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। এভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার মানুষদেরকে
শাসন ও শোষণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কৌশল গ্রহণ করে।
১৩. রাষ্ট্রপতির সর্বময় কর্তৃত্ব ও মৌলিক গণতন্ত্র : ১৯৫৮ সালে সমগ্র দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হলে দেশে রাজনৈতিক কার্যকলাপের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসন কাঠামোয় বাংলাদেশের সঠিক প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও অন্তত দাবিদাওয়া উত্থাপন করার পথ ছিল উন্মুক্ত। কিন্তু ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের পর সে পথও বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাগ্যে যা এসেছে তা শূন্যতার নামান্তর। ১৯৬২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন রাষ্ট্রপতি এবং শাসনকার্য পরিচালিত হতো সিভিল সার্ভিস ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের দ্বারা যার ফল হয় অত্যন্ত বিষময়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তান জন্মের পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগণ পূর্ব বাংলার জনগণের অতি বৈষম্যমূলক আচরণ সৃষ্টি করে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানিদের নানা শোষণ, নির্যাতন ও বঞ্চিত করতে থাকে অভিনব কৌশলের মাধ্যমে। এতে দুই পাকিস্তানের সম্পর্কে ফাটল ধরে। যার ফলশ্রুতিতে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।