অথবা, পরিবারের ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সমাজের মধ্যে পরিবার হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক গোষ্ঠী। জন্মমুহূর্ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ব্যক্তির জীবনে পরিবার প্রভাব বিস্তার করে চলে। পরিবার এমন এক গোষ্ঠী যার মধ্যে আমরা আমাদের নিজেদেরকে খুঁজে পাই। প্রত্যেকেই যেমন পরিবারের মধ্যে বেড়ে উঠে, ঠিক তেমনি আবার পরিবারের সদস্যও হতে হয়। প্রশ্নাতীতভাবে পরিবার হলো যে কোন গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানে ব্যক্তিমানুষের অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়। অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোতে আমরা দীর্ঘ বা অল্প সময়ের জন্য যুক্ত হই নিজের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। বিপরীতে পরিবারের মধ্যে আমরা সর্বদা বর্তমান।
পরিবারের কার্যাবলি : মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পরিবার কিছু কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। সমাজবিজ্ঞানীরা পরিবারের কার্যাবলিকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। নিম্নে পরিবারের কার্যাবলিসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. জৈবিক কাজ : পরিবারের আদি ও অকৃত্রিম কাজ Biological function. বস্তুত পরিবারেই নারী ও পুরুষ বৈধভাবে বসবাস করতে এবং আইনগতভাবে সন্তান উৎপাদন করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন
যদিও ক্রমশ পরিবারের কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসছে, তবুও Biological function এর জন্য পরিবার যুগের পর যুগ টিকে থাকবে।
২. প্রতিপালন : শিশুরা পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং শিশুদের সব ধরনের লালনপালন পরিবারই করে থাকে। জন্মের পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিশু অসহায় থাকে। পরিবারের সাহচর্য ও যত্নে শিশুকে সুস্থভাবে গড়ে তোলা হয় এবং সমাজের সদস্য হিসেবে পরিণত করা হয়।
৩. অবস্থান এবং সামাজিকীকরণ : একটি শিশু কিভাবে সমাজের সদস্য হয়ে উঠবে তা সম্পূর্ণরূপে তার পরিবারের উপর নির্ভর করে। শিশু জন্মের সাথে সাথেই মায়ের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসে। কিছুদিন পর শিশুটি বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাহচর্যে এসে বাইরের জগৎকে চিনতে ও জানতে থাকে। এভাবেই সামাজিকীকরণ নামক Life long process এর মাধ্যমে শিশুর ব্যক্তিত্ব, মনোভাব, চিন্তাধারা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, অনুভূতি ইত্যাদি তৈরি হয়। এমনকি সমাজে শিশুর অবস্থান কি হবে তাও তার পরিবার দ্বারাই নির্ধারিত হয়।
৪. অর্থনৈতিক কার্য : কৃষিভিত্তিক সমাজে পরিবারকে Unit of production হিসেবে গণ্য করা হতো। কেননা, উৎপাদন থেকে শুরু করে বণ্টন, ভোগ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ সবকিছুই পরিবারের ভিতর সম্পন্ন হতো। সময়ের পরিবর্তনে এখন আর পরিবারকে Unit of production হিসেবে গণ্য করা হয় না, বরং পরিবার হচ্ছে Unit of consumption.
৫. শিক্ষামূলক কার্য : এক সময়ে শিক্ষা ছিল সম্পূর্ণরূপে পরিবারভিত্তিক। ধর্মের পাশাপাশি সব ধরনের সাধারণ শিক্ষা পরিবারেই হতো। তবে এখনো শিশুদের প্রাথমিক অক্ষরজ্ঞান পরিবার দিয়ে থাকে।
৬. ধর্মীয় কার্য : ধর্মীয় কার্যক্রমের দিক থেকে বর্তমানে পরিবারের গুরুত্ব অনেকটা সীমিত হয়ে পড়েছে। এক সময় ব্যক্তির ধর্মীয় শিক্ষা ও কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণরূপে পরিবারভিত্তিক। তবে এখনো কোন কোন সমাজ (বাংলাদেশে) ধর্মীয় উৎসব পূজাপার্বণ, সবেবরাত এগুলো পরিবারেই সম্পন্ন হয়।
৭. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ : পরিবারের বিভিন্ন ধরনের কার্যাবলির মধ্যে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ অন্যতম। বস্তুত পরিবারকে কেন্দ্র করেই মানবসমাজে সর্বপ্রথম সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়েছিল। যেমন- অতীতের মানুষেরা Free sexual life lead করতো। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পরিবার জীবনের সূত্রপাত হয়। প্রতিটি পরিবারে নির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন আছে, যা তার সদস্যদের আচার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরিবারে বসবাস করতে হলে প্রতিটি ব্যক্তিকে এসব অলিখিত
নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়।
৮. মর্যাদা আরোপ এবং সামাজিক পরিচিতি : ব্যক্তি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে বলে ব্যক্তির Educational, religious ও eco nomic status পরিবারই দিয়ে থাকে। এছাড়া ব্যক্তি কিছু পদমর্যাদা উত্তরাধিকারসূত্রে পরিবার থেকে লাভ করে । বংশমর্যাদা, সম্পত্তির অংশীদারিত্ব ইত্যাদি এগুলোর অন্তর্গত।
৯. দৈহিক ও মানসিক নিরাপত্তা : একজন মানুষ সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য তার দৈহিক এবং মানসিক নিরাপত্তা প্রয়োজন। পরিবার একজন মানুষের দৈহিক এবং মানসিক উভয় দিকের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
১০. মানসিক আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি : প্রত্যেক মানুষ স্নেহ ভালোবাসা প্রেমপ্রীতির মধ্যে বেঁচে থাকতে চায় । পারিবারিক পরিবেশেই এ সুকুমার ভিত্তিগুলো বিকাশ সাধন সম্ভব। পরিবারের এ পরিবেশের মধ্যেই শিশুর মানসিক বৃত্তিসমূহ যথাযথভাবে বিকশিত হতে পারে ।
১১. সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ : স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তির সংরক্ষণ এবং উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা পরিবারের কাজ। পরিবারই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করে।
১২. সংস্কৃতির সংরক্ষক : সংস্কৃতি সভ্যতার নিদর্শনস্বরূপ। পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা অনুজদের সমাজের সাংস্কৃতিক জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
১৩. রাজনৈতিক কাজ : মানুষ শুধু পরিবারের সদস্যই নয়। সে রাষ্ট্রেরও একজন সদস্য। তাই রাষ্ট্রের প্রতি প্রত্যেক মানুষের কিছু দায়িত্ব কর্তব্য ও অধিকার থাকে। পরিবারের মাধ্যমেই শিশুর রাজনৈতিক শিক্ষা শুরু হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, পরিবারের কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক পরিবার সৃষ্টি হলেও সমাজের মৌলিক ও সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূলত পরিবারের কার্যাবলির মাধ্যমেই এর সর্বজনীনতা স্বীকৃত। আবার সময় এবং সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে পরিবারের কার্যাবলিতে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%aa%e0%a7%8d/
admin

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!