
ডিগ্রী অনার্স মাস্টার্স পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে পেতে Whatsapp এ ম্যাসেজ করুন। Whatsapp 01979786079
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা কর।
admin
- 0
অথবা, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরিণতি বা ফলাফল বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাঙালির জাতীয় জীবনে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। পরবর্তী দশকে এ চেতনার ক্রমবিকাশ ঘটে, যার ফলে একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের সম্ভব হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই পরবর্তীতে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশের উৎপত্তি হয়।
জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়। এরই প্রতিবাদে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের আহ্বানে সারাদেশে ধর্মঘট পালন। পাকিস্তান সরকার ঐদিন ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা এ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষার দাবিতে মিছিল করলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে ফলে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকে নিহত হয় এবং বহু ছাত্র আহত হয়। এ ভাষার দাবিতে গণ আন্দোলন পাকিস্তানের পরবর্তী আন্দোলনগুলোতে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। নিচে জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য বর্ণনা করা হলো :
১. ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধের উদ্ভব : ভাষা আন্দোলন জাতীয় জীবনে এর চেতনার উন্মেষ ঘটায়। বাঙালিদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অধিকার তথা স্বাধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
২. দাবি আদায়ের শিক্ষা : ভাষা আন্দোলন প্রথম বাঙালিদের রক্তের বিনিময়ে জাতীয়তাবাদী দাবি আদায়ের শিক্ষা দেয়। এ দৃষ্টান্ত থেকে বাঙালিরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার কায়েমের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার মতো দুর্জয় সংকল্প, সাহস ও অনুপ্রেরণা লাভ করে।
৩. জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা : ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এদেশের সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০ এর নির্বাচন, সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তানি
শাসকগোষ্ঠীর মোকাবিলা করেছে।
৪. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি : পূর্ব বাংলার মানুষ সুদূর অতীতকাল থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাধ্যমে বসবাস করে আসছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির সময় এ সম্প্রীতি নষ্ট হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পুনরায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়, যা স্বাধীনতা অর্জনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
৫. সকল শক্তির উৎস যোগায় : ভাষা আন্দোলন এদেশের বুদ্ধিজীবীদেরকে জনগণের সাথে একাত্ম করে তোলে এবং সমগ্র জাতিকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। ফলে বাঙালিদের মধ্যে যে বিপ্লবী ও সংগ্রামী চেতনার বিকাশ ঘটে তা পরবর্তীতে সকল আন্দোলনের প্রাণশক্তি সাহস ও প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে।
৬. প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব : ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্রসমাজ একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। ফলশ্রুতিতে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও পেশাদার শ্রেণিকে নিয়ে জোট গঠনের রীতি গড়ে উঠে। এ জোট পরবর্তীতে সকল আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
৭. গণতান্ত্রিক চেতনা সৃষ্টির সহায়ক : রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গণতন্ত্রের মর্মবাণী সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক শাসনের স্বীকৃতি প্রদান করে। শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়াস চালায়, যা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থি। বাঙালিরা এ গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়
৮. অর্থনৈতিক মুক্তি আন
্দোলনের অগ্রদূত : বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষায় পরিণত হলে পূর্ব বাংলার মানুষ শিক্ষাদীক্ষায় পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে পড়ত। শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হলে উচ্চতর সামরিক ও বেসামরিক চাকরিতে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের লোকদের প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে যেত এবং এ অঞ্চলের লোক অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এ ষড়যন্ত্রের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল।
৯. বাঙালির সর্বজনীন দাবি : বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদানের দাবি বাঙালিদের সর্বজনীন দাবি। এ দাবি আদায়ের প্রান্তে পূর্ব বাংলায় ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ সকল বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
১০. মধ্যবিত্ত বাঙালিদের রাজনৈতিক অবস্থান সৃষ্টি : ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিয়ামকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত সকল আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
১১. ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন : ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে এদেশের ছাত্রসমাজ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, যার অনুপ্রেরণা পেয়েছিল ভাষা আন্দোলন থেকে।
১২. ১৯৬৬ সালের ছয় দফা : ছয় দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ছয় দফা দাবি এ দেশবাসীর বাঁচার দাবি ছিল। ছয় দফা দাবি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মুক্তির দিকনির্দেশনা ছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণির এ দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়। এ ছয়দফা দাবির মূল প্রেরণা ছিল ভাষা আন্দোলন।
১৩. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান : ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল বাঙালির জাতীয় জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বাঙালিরা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে। এ বিজয় অর্জন ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতার অন্যতম মাইলফলক। এ গণঅভ্যুত্থান সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের সাফল্য মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করেছিল। এ গণআন্দোলনের মূলভিত্তি ছিল ভাষা আন্দোলন।
১৪. ১৯৭০ সালের নির্বাচন : ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের জাতীয়তাবাদী মনোভাবের চরম বিকাশ ঘটায়। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বস্তুত আওয়ামী লীগের এ বিজয়ে ভাষা আন্দোলন ছিল মূল অনুঘটক। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ‘৭০ এর নির্বাচনে।
১৫. ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে তার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির প্রথম সংগ্রাম ছিল ভাষা আন্দোলন এবং সর্বশেষ সংগ্রাম ছিল স্বাধীনতার, যা ছিল একই সূত্রে গাঁথা। দীর্ঘ ৯ মাস নিরস্ত্র বাঙালি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং বিজয় ছিনিয়ে এনেছে তার পিছনে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণা।
১৬. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : বাঙালিরাই প্রথম এবং একমাত্র জাতি যে জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে এবং আত্মত্যাগ করেছে। এজন্য ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে, যা আমাদের জাতীয় জীবনকে করেছে গৌরবোজ্জ্বল। আমাদের দেশকে, আমাদের শহিদদেরকে তাদের এ আত্মদান আজ সমগ্র বিশ্বে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষ
িতে বলা যায় যে, বাঙালির জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলন ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি, রাজনৈতিক অধিকার আদায়, অর্থনেতিক দাবি আদায়, সংস্কৃতি রক্ষাসহ সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে শক্তি ও সাহস প্রদর্শন করে বাঙালি জাতি, তার মূল অনুপ্রেরণা ছিল ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের পর হতে বাঙালি জাতি ধাপে ধাপে সামগ্রিক স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামের পথে অগ্রসর হয়। কাজেই বাঙালির জাতীয়জীবনে ভাষা আন্দোলন অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছিল ।