জৈন দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
অথবা, জৈন দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ রচনা লিখ।
অথবা, জৈন দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ধারা সংক্ষেপে লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে যে কয়েকটি দার্শনিক সম্প্রদায় রয়েছে তার মধ্যে একটি অন্যতম সম্প্রদায় হলো জৈন সম্প্রদায়। জৈন দার্শনিকগণ দর্শনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। জৈনদের দর্শন ছিল বিশুদ্ধ বস্তুবাদী দর্শন। তারা বিশ্বজগতের একটি পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন। বিশ্বজগতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তারা বিভিন্ন সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। নিম্নে জৈন দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
জৈন শব্দের উৎপত্তি : বুৎপত্তিগত দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, জৈন শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ‘জিন’ ধাতু থেকে। এই ‘জিন’ শব্দের অর্থ হলো জয়ী। জৈন তীর্থঙ্করগণকে জিন নামে অভিহিত করা হয়। জৈন তীর্থঙ্করগণকে জিন বলার কারণ হলো তারা রাগ, দ্বেষ প্রভৃতি রিপুগুলোকে জয় করেছিলেন।
জৈন দর্শনের প্রচারক : জৈন দর্শন অতি প্রাচীন। এর আবির্ভাব হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগে চব্বিশজন তীর্থঙ্কর জৈন দর্শনের প্রচারক। এই প্রচারকদের প্রথম জনের নাম ঋষভদেব এবং সর্বশেষ জনের নাম বর্ধমান। বর্ধমানের অপর নাম মহাবীর।
জৈন দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা : মহাবীরকেই প্রকৃত পক্ষে জৈন ধর্ম ও দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বলে সকলে মনে করে। এছাড়াও জনশ্রুতি আছে যে, জৈন ধর্ম ও দর্শনের প্রধান গ্রন্থগুলোতে যেসব উপদেশ ও বাণী আছে সেসব এই মহাবীরেরই দান। হাবীরের জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। তিনি ছিলেন গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক।
জৈন সম্প্রদায় : দর্শনের মূলনীতিকে কেন্দ্র করে জৈনগণের মধ্যে কোন পার্থক্য না থাকলেও ধর্মীয় আচারব্যবহার নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায় এবং তারা শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর এ দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ধর্মীয় নিয়ম, আচার প্রভৃতি পালনের ব্যাপারে শ্বেতাম্বর সম্প্রদায় খুবই উদার, কিন্তু দিগম্বরগণ আচার-নিষ্ঠায় অত্যন্ত কঠোর।
পোশাক পরিচ্ছদ ও আচার অনুষ্ঠান : শ্বেতাম্বরগণের মতে, সন্ন্যাসীদের উচিত শ্বেত বস্ত্র পরিধান করা, কিন্তু দিগম্বরগণের মতে, সন্ন্যাসীদের নগ্ন ও সম্বলহীন থাকা উচিত এবং কোন বস্তুর প্রতি তাদের আসক্তি থাকা উচিত নয়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এ উভয় সম্প্রদায়ই তীর্থঙ্করদের উপদেশ মেনে চলতেন।
তীর্থঙ্করদের অনুসরণ : সর্বজ্ঞতা, সর্বশক্তিমত্তা প্রভৃতি ঐশ্বরিক গুণে বিভূষিত তীর্থঙ্করদেরকে জৈনরা ঈশ্বরের স্থলাভিষিক্ত বলে মনে করেন। তাদের মতে, মানুষের উচিত এই তীর্থঙ্করদের পবিত্র চরিত্রকে অনুসরণ করে যে কোন ব্যক্তি মুক্তির পথে অগ্রসর হতে পারে। তীর্থঙ্করগণ মুক্তির পথে আলোকবর্তিকার কাজ করেন। তবে মুক্তিলাভ করতে হলে মানুষকে নিজের চেষ্টায় তা লাভ করতে হবে, অপরের অনুগ্রহে নয়।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, জৈন দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ধারা থেকে দেখা যায় এই মতবাদ গোড়া থেকেই মৌলিকত্বের দাবিদার। জৈনগণের দার্শনিক মতবাদকে বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং বহুত্ববাদ বলা যায়। কারণ তারা বাহ্যজগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন এবং একাধিক সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করেন।