জৈন তত্ত্ববিদ্যা আলোচনা কর।
অথবা, অধিবিদ্যা সম্পর্কে জৈন অভিমত আলোচনা কর।
‘অথবা, জৈন অধিবিদ্যা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, তত্ত্ববিদ্যা সম্পর্কে জৈন অভিমত ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জৈন দর্শন একটি প্রাচীন দর্শন। জৈন দর্শনের আবির্ভাব হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগে। চব্বিশজন তীর্থঙ্কর জৈন দর্শনের প্রচারক। মহাবীরকে জৈন ধর্ম ও দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। জৈনগণ নিরীশ্বরবাদী ও বস্তুবাদী। জৈনগণ দর্শনের বিভিন্ন সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনা করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো তত্ত্ববিদ্যা বা অধিবিদ্যা। প্রশ্ন অনুসারে নিম্নে তত্ত্ববিদ্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
তত্ত্ববিদ্যা কী : দর্শনের যে শাখায় বস্তুর অতীন্দ্রিয় স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকেই অধিবিদ্যা বা তত্ত্ববিদ্যা বলে । দ্রব্য, দেশ, কাল, জড়, মন, প্রাণ, আত্মা, আত্মার অমরত্ব, ঈশ্বর ইত্যাদির স্বরূপ নির্ণয় করাই অধিবিদ্যার কাজ। জৈন তত্ত্ববিদ্যা বা অধিবিদ্যা। জৈনরা দর্শনের বিভিন্ন সমস্যার মতো তত্ত্ববিদ্যা নিয়েও আলোচনা করেছেন যা নিম্নে তুলে ধরা হলো :
অনেকান্তবাদ : জৈন মতে, যে কোন বস্তুর অনন্ত ধর্ম আছে। এ ধর্ম ২ প্রকার। যথা : ভাবাত্মক এবং অভাবাত্মক। বস্তুর এ উভয় প্রকার ধর্মই সংখ্যাতে অনেক। ভাবাত্মক ধর্ম হলো সেগুলো যার দ্বারা বস্তুর স্বরূপ বা প্রকৃতি নিরূপণ করা হয়। যেমন— একটি গরুর ভাবাত্মক ধর্ম হলো তার আকার, প্রকৃতি, জাতি, বর্ণ, জন্মস্থান, জন্মসময় ইত্যাদি। যেসব ধর্মের অনুপস্থিতির জন্য বস্তুটি জগতের অন্যান্য বস্তু হতে ভিন্ন তাদের অভাবাত্মক ধর্ম বলা হয়। যেমন- গরুটি বৃহদাকার নয়, কাল নয়, বলিষ্ঠ নয়, সুন্দর নয়, বঙ্গদেশীয় নয় ইত্যাদি। বস্তুর ভাবাত্মক ধর্ম হতে অভাবাত্মক ধর্মের সংখ্যা অনেক বেশি কারণ এ অভাবাত্মক বস্তুটিকে জগতের অপরাপর বস্তু হতে আলাদা করে। কালচক্রের পরিবর্তনে বস্তুর মধ্যে যেমন কতগুলো ধর্ম অন্তর্হিত হয় তেমনি কতগুলো নতুন ধর্মের আবির্ভাবও হয়। জৈন মতে, কোন বস্তুর পূর্ণজ্ঞান বলতে বস্তুর এ অসংখ্য ভাবাত্মক ও অভাবাত্মক ধর্মের জ্ঞান বুঝায়। তবে এক কেবল জ্ঞান ছাড়া কোন বস্তুকে সম্যকরূপে জানা সম্ভব নয়। তবে ব্যবহারিক জীবনে কোন বস্তুর আংশিক জ্ঞান লাভ করতে পারলেই চলে।
দ্রব্য : জৈনদের মতে, যা গুণ এবং পর্যায়বিশিষ্ট তাই দ্রব্য। যাতে ধর্ম আছে তাই ধৰ্মী। ধর্মীই হলো দ্রব্য? যা দ্রব্যেরস্বাভাবিক বা স্বরূপগত ধর্ম এবং যার জন্য দ্রব্য স্থিতিশীল বলা হয় গুণ। যেমন- আত্মার চৈতন্য ধর্ম। আর যা দ্রব্যের আগন্তুক ধর্ম এবং যার জন্য দ্রব্য পরিবর্তনশীল তাকে বলা হয় পর্যায়। যেমন- ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ-দুঃখ প্রভৃতি আত্মার আগন্তুক ধর্ম। গুণ হলো নিত্যধর্ম আর পর্যায় হলো অনিত্যধর্ম। গুণের দিক দিয়ে দ্রব্য স্থিতিশীল এবং পর্যায়ের দিক থেকে দ্রব্য পরিবর্তনশীল। গুণ ও পর্যায়ের আধার রূপে দ্রব্য অপরিনামী। জৈনরা বৌদ্ধদের ক্ষণিকত্ববাদ এবং বেদান্ত দর্শনের নিত্যবাদ উভয়ই অস্বীকার করেন। জৈনদের মতে, দ্রব্যের পরিবর্তন ও স্থায়িত্ব উভয়ই সত্য। দ্রব্য একাধারে পরিণামী এবং অপরিণামী। কোন বিশেষ দিক থেকে দ্রব্যকে পরিণামী এবং কোন বিশেষ দিক থেকে দ্রব্যকে অপরিণামী বলা যেতে পারে। জৈন স্যাদবাদ অনুসারে প্রতিটি অবধারণই আপেক্ষিক। এ কথা মনে রাখলে আর কোন বিরোধ দেখা দেয় না।
দ্রব্যের প্রকারভেদ : জৈনদের মতে, দ্রব্য ২ প্রকার। যথা : অস্তিকায় এবং অনস্তিকায়। যার বিস্তৃতি আছে যা দেশ জুড়ে থাকে তাকে অস্তিকায় বলে। আর যার বিস্তৃতি নেই, যা দেশ জুড়ে থাকে না তাকে অনস্তিকায় বলে। একমাত্র কাল ছাড়া আর সব বস্তুই অস্তিকায়। অস্তিকায় বস্তু আবার ২ প্রকার। যথা : জীব এক অজীব। জীব ও আত্মা এক ও অভিন্ন।
জীবকে আবার দুটি শ্রেণীত
ে ভাগ করা হয়। যথা : মুক্ত ও বদ্ধ। বদ্ধ জীব আবার ২ প্রকার। যথা : এস অর্থ গতিশীল এবং স্থাবর বা গতিহীন। স্থাবর জীব ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরূৎ এবং উদ্ভিদ এ পাঁচ প্রকার দেহে বাস করে। এস বা গতিশক্তিমান জীবদের কারো দুই, কারো তিন, কারো চার, কারো পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে। অজীব চার প্রকার। যথা : ধর্ম, অধর্ম, আকাশ, পুদগল (ড়)। পুদগল ২ প্রকার। অণু এবং সংঘাত।
জীব বা আত্মা : জৈন মতে, জীব ও আত্মা অভিন্ন, যে দ্রব্যের চেতনা আছে তাই জীব। চৈতন্য আত্মার স্বরূপগত ধর্ম। চেতনা সব সময়ই আত্মাতে বর্তমান থাকে যদিও আত্মা বা জীবদেহে চৈতন্যের অস্তিত্ব কম বেশি হতে পারে। সকল রকম কর্মের বন্ধন থেকে যারা মুক্ত সেই জীবদের চেতনা সবচেয়ে বেশি এবং ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরূৎ ও উদ্ভিদ দেহদারী
জীবের চেতনা সবচেয়ে কম। আত্মা জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা। আত্মা নিজেকে এবং বিষয়কে প্রকাশ করে। আত্মা নিত্য ও অপরিণামী, যদিও তার অবস্থার পরিবর্তন আছে। আত্মা, ও দেহ এক নয়, আত্মা দেহ থেকে ভিন্ন এক অতিরিক্ত সত্তা। আত্মা স্বপ্রকাশ, আত্মা নিজের অস্তিত্ব নিজেই প্রকাশ করে। পূর্বজন্মকৃত কর্মানুসারে আত্মা একের পর একটি দেহ ধারণ করে এবং যখন যে দেহে থাকে সে দেহের আকার ধারণ করে। দেহের বাইরে আত্মার কোন বিস্তৃতি নেই। দেহের অভ্যন্তরস্থ বিষয় আত্মা সাক্ষাৎভাবে জানতে পারে এবং আত্মা সমস্ত দেহ জুড়ে থাকে বলে দেহের সব অংশের অনুভূতি জীবের পক্ষে লাভ করা সম্ভব। প্রতিটি আত্মাই জড়ের, প্রতিবন্ধকের অনুপস্থিতিতে সোজাসুজি এবং সাথে সাথে সব কিছু জানতে পারে। জড় ছাড়াও আত্মা থাকতে পারে। মুক্ত আত্মা দেহ ছাড়াই অবস্থান করে। জৈনরা বহু আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। জৈন মতে, যদি একাধিক আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করা না যায় তাহলে এক জীবকে অন্য জীব থেকে পৃথক করা সম্ভব হবে না। যদি একই আত্মা সব জীবের মধ্যে থাকতো তাহলে তাদের কর্মফল পৃথক হতো না, পাপী ও পুণ্যবানদের মধ্যে পার্থক্য করা যেতো না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, জৈনরা তত্ত্ববিদ্যার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। তবে তত্ত্ববিদ্যার দুরূহ সমস্যার মীমাংসা করা জৈন দর্শনের লক্ষ্যই নয়। জৈন দর্শন মূলত আত্মনির্ভরতার দর্শন পুরষ্কারের দর্শন। এ কারণেই সিদ্ধ পুরুষদের জৈন বা জয়ী এবং বীর আখ্যা দেয়া হয়।