জৈন জ্ঞানতত্ত্ব ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ কর।
অথবা, জৈন মতে জ্ঞান বলতে কী বুঝ? জ্ঞানের শ্রেণিবিভাগ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জৈন জ্ঞানতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জৈন মতে, প্রমা বা যথার্থ জ্ঞানের প্রকারভেদ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতীয় দর্শনের নাস্তিক সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে জৈন দর্শন অন্যতম। জৈন শব্দের উৎপত্তি জিন’ শব্দ হতে। ‘জিন’ শব্দের অর্থ ‘জয়ী’। জৈন তীর্থঙ্করগণকে ‘জিন’ নামে অভিহিত করা হয়। কারণ তাঁরা রাগ, দ্বেষ প্রভৃতি রিপুগুলোকে জয় করেছিলেন। সমস্ত জৈন দর্শনকে জ্ঞানতত্ত্ব, পরাতত্ত্ব এবং নীতি ও ধর্ম এ তিন ভাগে ভাগ করা যায়। তন্মধ্যে জ্ঞানতত্ত্ব জৈন দর্শনের অন্যতম প্রধান আলোচ্যবিষয় ।
জৈন জ্ঞানতত্ত্ব : জৈন মতে, পদার্থের যথাযথ ধারণাই জ্ঞান। অর্থাৎ যে বস্তু বাস্তবে যা তাকে সে বস্তু বলে জানাকেই জ্ঞান বলা হয়। যে ধারণায় কোন প্রকারের সন্দেহ থাকে সে ধারণাকে যথার্থ জ্ঞান বলা যায় না। যথার্থ জ্ঞানে কোনরকম সন্দেহ থাকতে পারে না। যথার্থ জ্ঞান মানুষের উদ্দেশ্য সাধনে সাহায্য করে। জৈনগণ বলেছেন, জ্ঞাত বস্তুর সাথে জ্ঞাতার যখন সঠিক পরিচয় ঘটে তখন জ্ঞানের উৎপত্তি হয়। এ দুটির কোন একটি অভাব থাকলে জ্ঞান সম্ভব নয়। জীব বা আত্মা হলো জ্ঞাতা। চার্বাকগণ জ্ঞান বা চৈতন্যকে আত্মার অবান্তর গুণ বলেছেন। কিন্তু জৈনরা এ মতের বিরোধিতা করে বলেছেন, জ্ঞান বা চৈতন্য জীব বা আত্মার স্বাভাবিক ও অবিচ্ছেদ্য গুণ বা ধর্ম । জৈন দার্শনিকগণ আরো বলেছেন, জ্ঞানের পথে বাধাপ্রাপ্ত না হলে জীব বা আত্মা সর্বজ্ঞ হতো। সর্বজ্ঞতা আত্মার স্বাভাবিক গুণ। অবিদ্যামূলক ফলের কারণে সর্বজ্ঞ আত্মা যখন দেহাবদ্ধ হয়, তখন তার সর্বজ্ঞতা সাময়িকভাবে ঢাকা পড়ে, যেমন সূর্যালোককে মেঘ সাময়িকভাবে ঢেকে রাখে। মেঘাবৃত্ত সূর্য মেঘমুক্ত হলে যেমন তা স্বাভাবিক কিরণ বিকাশ লাভ হয়, তেমনি সর্বজ্ঞ আত্মার সর্বজ্ঞতা প্রকাশ পায়, যখন সে দেহের বন্ধন মুক্তি পায়। মুক্ত আত্মা সকল বস্তুকে সাক্ষাৎভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারে। জৈনগণের মতে, জ্ঞান ও জ্ঞানের বস্তু ভিন্ন। জ্ঞানের বস্তু জ্ঞান বা জ্ঞাতার উপর নির্ভরশীল নয়। জ্ঞান জ্ঞানের বস্তুকে প্রকাশ করে মাত্র। সূর্য যেমন নিজেকে এবং অন্য বস্তুকে প্রকাশ করে, অবশ্য যদি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না হয়। জৈন মতে, জ্ঞানের বস্তুর স্বতন্ত্র সত্তা আছে।
জ্ঞানের প্রকারভেদ : জৈন মতে, প্রমা বা যথার্থ জ্ঞান পাঁচ প্রকারের। যথা : মতি, শ্রুত, অবধি, মনঃপর্যায় ও কেবল। নিম্নে এসব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. মতি : পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মনের মাধ্যমে যে জ্ঞান লাভ করা হয় তাকেই ‘মতি’ বলে। চক্ষু, কর্ণ প্রভৃতি পঞ্চ বহিরিন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রাপ্ত বাহ্যবস্তুর প্রত্যক্ষ জ্ঞান, মনের সাহায্যে মানসিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আন্তঃপ্রত্যক্ষ জ্ঞান, স্মৃতি, প্রত্যভিজ্ঞা এবং অনুমান এ সবই ‘মতি’ জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। যে জ্ঞানকে সরাসরি সাক্ষাৎভাবে লাভ করা যায় সে জ্ঞান প্রত্যক্ষ
জ্ঞান; আর যে জ্ঞানকে সরাসরি সাক্ষাৎভাবে লাভ করা যায় না, সে জ্ঞান পরোক্ষ জ্ঞান। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে পরোক্ষ জ্ঞান বলেছেন। কারণ এ জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে লাভ করা হয়। স্মৃতি, প্রত্যভিজ্ঞা ও অনুমান পূর্ব জ্ঞানের মাধ্যমে লাভ করা হয়। বলে এদেরও পরোক্ষ জ্ঞান বলা হয়। সুতরাং জৈন মতে, ‘মতি’ পরোক্ষ জ্ঞান, প্রত্যক্ষ জ্ঞান নয়।
২. শ্ৰুত : বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি বা শাস্ত্রবাক্যের উপর নির্ভর করে যে জ্ঞান লাভ করা হয় তাই শ্রুত। অর্থাৎ শব্দ প্রমাণ হতে যে জ্ঞান লাভ করা হয় তাকে জৈনগণ শ্রুত বলেছেন। শ্রুতও পরোক্ষ জ্ঞান, কেননা এটা অপরের নিকট হতে পাওয়া যায়। জৈনগণ বেদকে ‘শব্দ’ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেন না।
৩. অবধি : জ্ঞাতা তার সাধনালব্ধ অসাধারণ শক্তি বলে সুদূর অতীত ও ভবিষ্যৎ অতি দূরবর্
তী এবং সূক্ষ্ম পদার্থ সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্জন করে সে জ্ঞানই ‘অবধি’। অন্য জ্ঞান বা ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর না করে জ্ঞাতা সাক্ষাৎভাবে এ জ্ঞান লাভ করে বলে জৈনগণ একে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলেছেন।
৪. মনঃপর্যায় : রাগ, হিংসা, দ্বেষ প্রভৃতি রিপুকে মানুষ জয় করতে পারলে তার ভেতর এমন একটি শক্তির উদ্ভব হয়, যার দ্বারা তিনি অন্যের সুখ, দুঃখ প্রভৃতি মানসিক অবস্থাকে সাক্ষাৎভাবে জানতে পারে। অপরের মানসিক অবস্থাকে সাক্ষাৎভাবে জানাই হলো মনঃপর্যায়। মনঃপর্যায় প্রত্যক্ষ জ্ঞান, কেননা এটা ইন্দ্রিয় নির্ভর নয়। এ জ্ঞানে জ্ঞাতা সাক্ষাৎভাবে অন্যের মনে প্রবেশ করে।
৫. কেবল : সর্বকালের, সর্বদেশের এবং সর্বপদার্থের সাক্ষাৎ জ্ঞানকে ‘কেবল জ্ঞান’ বলা হয়। ‘কেবল জ্ঞান’ দেশ, কাল প্রভৃতি সকল রকমের সীমা ও বিভেদের ঊর্ধ্বে। একমাত্র বন্ধনমুক্ত সিদ্ধ মানুষই এ জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে। ‘কেবল জ্ঞান’ ইন্দ্ৰিয় বা অন্য কোন জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল নয় বলে একেও প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলা হয়। এ জ্ঞান বিশুদ্ধ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, জৈনরা জ্ঞান বলতে সুস্পষ্ট ও যথার্থ ধারণাকে বুঝিয়েছেন। প্রকৃত জ্ঞান হতে হলে জ্ঞাতার সাথে জ্ঞেয়বস্তুর নির্দিষ্ট সম্পর্ক থাকতে হবে। তবে জৈনদের মতে, জ্ঞানের বস্তু জ্ঞান বা জ্ঞাতার উপর নির্ভরশীল নয়। জৈনগণ প্রত্যক্ষ অনুমান ও শব্দকে প্রমাণরূপে স্বীকার করেন। জৈনগণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মন, বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির আপ্তবাক্য, সাধনালব্ধ জ্ঞান সাক্ষাৎকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে স্বীকার করেছেন।