জাতীয় রাজনীতি বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব আলোচনা কর।
অথবা, জাতীয় রাজনীতি কী? স্থানীয় রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির উপর কতটুকু প্রভাব বিস্তার করে? বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আলোচনা কর।
অথবা, রাজনীতি কাকে বলে? বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব বর্ণনা কর।
ভূমিকা : গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাজনীতি করা সকল জনগণের অন্যতম একটি প্রধান গণতান্ত্রিক অধিকার। সাধারণ অর্থে সরকারের ক্রিয়াকলাপ ও জনগণের মধ্যে সরকারি ক্ষমতা গ্রহণের বা তথ্য সংক্রান্ত কাজের সাথে সম্পৃক্ততাকে রাজনীতি বলে। আর জাতীয় রাজনীতি হলো জাতীয় পর্যায় বা কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায় নিয়োজিত থাকা বা সম্পৃক্ততা।
জাতীয় রাজনীতি : রাজনীতি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মধ্যে দিয়ে মানুষ তার রাজনৈতিক আদর্শ অনুসারে। নিজের সমাজকে বিন্যস্ত করে। রাজনীতিকে বাদ দিয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করা যায় না। প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত। তাই এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল বলেছেন যে “মানুষ মাত্রই জনৈতিক জীব।” রাজনৈতিক ব্যবস্থা মূলত দুইটি ধারায় প্রচলিত হয়ে থাকে। যেমন- স্থানীয় রাজনীতি এবং কেন্দ্রীয় বা জাতীয় রাজনীতি। সহজ কথায় বলা যায় যে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের যে রাজনীতি তাই হলো জাতীয় রাজনীতি। জাতীয় রাজনীতি বা রাজনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তার কয়েকটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটলের মতে, “কোন সুসংগঠিত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজের উত্তম জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কযুক্ত সকল কিছুই রাজনীতির আওতাভুক্ত।” ম্যাক্স ওয়েবার এর মতে, রাজনীতি হচ্ছে একটি সাধারণ মানবীয় কর্মকাণ্ড যা সমাজের মধ্যে উদ্ভব হয়। বিভিন্ন এজেন্ডা নির্ভর করে এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত।” অ্যালান বল এর মতানুসারে “রাজনীতি হচ্ছে একটি সক্রিয় বা সার্বিক ক্রিয়া। এখানে কোনো রকম নৈতিক নির্দেশ নয় সামগ্রিক ক্রিয়ার চর্চা হয়। সরকারের সকল কার্যক্রম রাজনৈতিক ক্রিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত স্বীকৃত রাজনৈতিক কাঠামোর→ মধ্যে অনেক ধরনের ক্রিয়াকলাপের উদ্ভব হয়। এ ধরনের সকল ক্রিয়াকলাপের মধ্যে রাজনীতির কর্মকাণ্ড জড়িত থাকে।” সুতরাং বলা যায় যে, জাতীয় রাজনীতি হলো সকল রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। জাতীয় রাজনীতির দ্বারা সমগ্র রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয় ।
জাতীয় রাজনীতিতে স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব : বাংলাদেশের স্থানীয় রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির উপর খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে আছে। জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি মূলত স্থানীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। যে সকল উপাদান স্থানীয় রাজনীতির পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, সেই সকল উপাদান আবার জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কেন্দ্রীয় রাজনীতিকে মূলত জাতীয় রাজনীতি বলা হয়ে থাকে। এই রাজনীতির উপর স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব অনেক বেশি। যার ফলে কেন্দ্রীয় রাজনীতিকে স্থানীয় রাজনীতি বহুলাংশে প্রভাবিত করে থাকে। নিম্নে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব আলোচনা করা হলো :
১. নেতৃত্ব সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে : স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এক সময় জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে প্রবেশ করে থাকে। এ সকল স্থানীয় নেতৃবৃন্দ জাতীয় রাজনীতি পরিচালনা করে থাকে। তাই বলা যায় যে, জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ স্থানীয় রাজনীতির মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়।
২. জন অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে : মূলত স্থানীয় রাজনীতির মাধ্যমেই জনগণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। স্থানীয় রাজনীতি জনগণকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উন্নয়ন সাধন করে থাকে।
৩. নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে : সরকারে বিভিন্ন নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনীতি জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করে থাকে। বিশেষ করে জনকল্যাণমূলক নীতি প্রণয়নে স্থানীয় রাজনীতি জাতীয় বা কেন্দ্রীয় সরকারকে সহায়তা করে থাকে। যার ফলে সরকার সঠিক ও জনকল্যাণমূলক নীতি প্রণয়নে সমর্থ হয়।
৪. নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে : স্থানীয় সরকার শুধু সরকারি নীতি প্রণয়নে সহায়তা করে না বরং সরকারি নীতি বাস্তবায়নেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সরকারি নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার জাতীয় সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
৫. উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে : বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে স্থানীয় সরকার যে সকল ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে। উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার জনগণের দাবি বা চাহিদা অনুসারে জাতীয় সরকারকে তথ্য প্রদান করে থাকে। আর সে তথ্য অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকার উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে থাকে।
৬. সরকারি কার্যক্রম সফল করার ক্ষেত্রে : স্থানীয় সরকার স্থানীয় জনগণের দ্বারা গঠিত হওয়ায়ই সরকারি কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে সক্ষম হয়। সরকারি কার্যক্রম সফল করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। স্থানীয় রাজনীতির সহযোগিতা ছাড়া সরকারি কোনো কার্যক্রমই সফল হতে পারে না। তাই বলা যায় যে এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে আছে।
৭. দিক নির্দেশনার মাধ্যম হিসেবে : সকল দেশেরই স্থানীয় সরকার স্থানীয় জনগণ দ্বারা গঠিত। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। স্থানীয় সরকার স্থানীয় জনসাধারণের দোরগোড়ায় অবস্থান করে। এই স্থানীয় সরকার জনগণের সমস্যা সম্পর্কে অবগত। তাই জাতীয় সরকারের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় দিক নির্দেশনা প্রদান করে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সরকারের দিক নির্দেশনা অনুসারে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করে থাকে।
৮. কর্মপন্থা নির্ধারণের ক্ষেত্রে : বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার জাতীয় সরকারের উপর যে সকল ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো কর্মপন্থা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সরকারের কর্মপন্থা বা কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
৯. স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টিতে : বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার জাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে আছে। জাতীয় রাজনীতির স্থিতিশীলতা স্থানীয় রাজনীতির স্থিতিশীলতার উপর নির্ভর করে। স্থানীয় রাজনীতি স্থিতিশীল থাকলে জাতীয় রাজনীতিও স্থিতিশীল থাকবে।
উপসংহার : আলোচনা শেষে বলা যায় যে, জাতীয় রাজনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্থানীয় রাজনীতির উপর নির্ভরশীল। কেননা স্থানীয় রাজনীতি সরাসরি জনগণ দ্বারা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন সাধন করতে হলে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে হবে। যেহেতু স্থানীয় সরকার স্থানীয় জনগণের দ্বারা গঠিত। তাই স্থানীয় সরকারের প্রদানকৃত তথ্য অনুসারে সরকারি নীতি ও পরিকল্পনা গৃহীত হলে দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।