অথবা, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়সমূহ
আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে কিরূপ পরিবেশগত বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে কিরূপ ক্ষয়ক্ষতি হয় তা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ হলো বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হলো গ্রিন হাউস গ্যাস (Green house effect). সাধারণত সূর্য থেকে যে তাপশক্তি পৃথিবী পৃষ্ঠে আসে তার কিছু অংশ পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে এবং অধিকাংশ বিকরিত হয়ে পুনরায় বায়ুমণ্ডলে চলে যায়। গ্রিন হাউস গ্যাসের জন্য দায়ী গ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন এবং নাইট্রোজেন ও সালফার অক্সাইডসমূহ। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবী পৃষ্ঠে প্রতিনিয়ত দেখা দিচ্ছে নানা পরিবেশগত বিপর্যয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়সমূহ : বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের যেসব বিপর্যয়সমূহ পরিলক্ষিত হয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. প্লাবন : বাংলাদেশে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে যেসব বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অন্যতম। বস্তুত এ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ২০,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্লাবনজনিত সমস্যার সম্মুখীন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের মোট ভূমির ১৭ শতাংশ তলিয়ে যাবে এবং জনসংখ্যার একপঞ্চমাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জলবায়ু পরিবর্তিত হলে বৃষ্টিপাত বাড়বে। ফলে দেখা দেবে বন্যা, বন্যাকবলিত এলাকার পরিসর বৃদ্ধি পাবে।
২. খরা : যে কোন এলাকার মাটিতে আর্দ্রতার অভাব তথা বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবনের মাত্রা বেশি হলে খরা দেখা দেয়। বাংলাদেশে উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে বর্ষাকালে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত ও পানির অভাবে রোপা, আমন আবাদে অসুবিধা হয় এবং ধানের ফলনও কমে যায়। শীতকালে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের তুলনায় অধিকহারে বাষ্পীভবনের ফলে মাটির
আর্দ্রতা হ্রাস পায় এবং কৃষিকাজে ব্যাপক ক্ষতি হয়।
৩. নদনদীর প্রবাহ : আমাদের মত কৃষিপ্রধান দেশে জমিতে সেচ ও নৌ চলাচলের জন্য নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নদনদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। এতে প্রধান প্রধান নদীর প্রবাহ হ্রাস পাবে।
৪. পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি : পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি দেশের কৃষি ও অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি। বর্তমানে বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চল ও দূরবর্তী দ্বীপসমূহের প্রায় ১.৪ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায় পানি প্রবেশ করায় উন্মুক্ত জলাশয় এবং ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানি ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে উপকূলীয় পরিবেশ সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
৫. বন্যা : পাহাড়ি বৃষ্টিপাতের কারণে বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে বিশেষত মেঘনা অববাহিকায় প্রতি বছরই আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের প্রায় ৪ হাজার বর্গ কি. মি. এবং দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের প্রায় ১ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা এ ধরনের আকস্মিক বন্যার শিকার। ফলে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
৬. নদী তীর ও মোহনার ভাঙন : বাংলাদেশে মোট ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র তটরেখা রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন উপকূল ঘিরে রয়েছে ১২৫ কিলোমিটার আর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ৮৫ কিলোমিটার। নদী সঙ্গমে অবস্থিত এসব বদ্বীপ ও সমুদ্র তটরেখা বরাবর ভূখণ্ড প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল । জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিরাজমান এ ভারসাম্য
অবস্থা আর টিকে থাকবে না।
জলব
ায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি : বাংলাদেশের জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় একদিকে যেমন মানুষ, গবাদিপশু ও বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হয় অন্যদিকে তেমনি বহু সম্পদের ধ্বংসসাধন হয়। নিম্নে সংক্ষেপে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. প্লাবন ও ভৌত অবকাঠামো : ১৯৯০ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট বস্তুগত সম্পদের পরিমাণ হবে ১৮০০ মিলিয়ন টাকা। এর মধ্যে ভৌত অবকাঠামো রয়েছে ২৮৪ বিলিয়ন টাকা মূল্যের। বিদ্যমান অবকাঠামোর শতাংশই অবস্থানান্তরযোগ্য বাড়িঘর। IPCC এর সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্লাবনজনিত কারণে বস্তুগত সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ২৪২ বিলিয়ন টাকা।
২. প্লাবন ও কৃষি : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কৃষির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। IPCC এর সমীক্ষায় গতানুগতিক উন্নয়ন ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী শতাব্দীতে প্লাবনের কারণে দেশে আমন ধানের উৎপাদন ১৩.৬ মিলিয়ন মেট্রিকটন হ্রাস পাবে।
৩. জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশীয় রীতি : জলবায়ুর পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি দেশের পরিবেশীয় রীতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। এদেশে জনসংখ্যার তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদ অপ্রতুল। জলবায়ুর পরিবর্তন হলে সম্পদের অপ্রাপ্যতা আরও বেড়ে যাবে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে।
৪. আকস্মিক বন্যা ও জনগোষ্ঠী : জলবায়ুর পরিবর্তন হলে দেশে অতি বৃষ্টি দেখা দিবে এবং এতে নদী প্রবাহের পরিবর্তন হয়ে দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল, মধ্য অঞ্চল ও দক্ষিণপূর্বাঞ্চলে পাহাড়ি ঢলের কারণে ঘন ঘন আকস্মিক বন্যা দেখা দিবে।
৫. জনগোষ্ঠী ও প্লাবন : বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কোন মাঝারি প্লাবনে দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ ভাগ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতের সাথে যে ৫৪টি নদীর পানি প্রবাহের বিষয়ে সহযোগিতা আবশ্যক তাতে ব্যত্যয় ঘটলে এ বিপন্নতা আরও ব্যাপক হবে।
৬. লোনা পানির অনুপ্রবেশ ও কৃষির বিপন্নতা : বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ বসবাস করে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে। IPCC এর হিসাবানুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০০ সে.মি. বৃদ্ধি পেলে ২৫,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটবে। ফলে দেশের প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ লোকের জীবন ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, জলবায়ুর পরিবর্তন একটি আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপক ও ধ্বংসাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে। কিন্তু এদেশের পক্ষে তার প্রতিরোধের ক্ষমতা ও সামর্থ্য সীমিত। অতএব, এ কথা স্মরণ রেখে কৌশলগতভাবে অগ্রসর হতে হবে। যাতে দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতিকে রক্ষা করা যায়।

ডিগ্রী অনার্স মাস্টার্স পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে পেতে Whatsapp এ ম্যাসেজ করুন। Whatsapp 01979786079