ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচির দফাগুলো আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ছাত্রদের দাবি ও এর গুরুত্ব আলোচনা কর।
অথবা, ১১ দফা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিরীহ বাঙালির উপর নির্যাতন, শাসন, শোষণ, অত্যাচার চালায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি জাতি মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ৬ দফা কর্মসূচি ও ১১ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী যখন ৬ দফা দাবি ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা উত্থাপন করে। ১১ দফা দাবিতে আন্দোলন বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
১৯৬৯ এর ১১ দফা দাবির পটভূমি : ১৯৬৭ সালে ১৩ আগস্ট প্রধান বিচারপতি হামিদুর রহমান বলেন, উর্দু এবং বাংলা উভয় ভাষাই লেখা উচিত আরবি হরফে। তার এ বক্তব্য বাঙালি জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ৬ দফাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য স্বৈরাচারী আইয়ুব-মোনায়েম সাংবাদিক তোফাজ্জলকে গ্রেফতার ‘নিউ নেশন’ ও ‘ইত্তেফাক’ প্রকাশনা বন্ধ ঘোষণা করে। ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় অভিযুক্ত ও দেশরক্ষা আইনে আটক এবং ১৭ জানুয়ারি বেকসুর খালাস পান। ১৮ জানুয়ারি আবার তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং প্রেসনোটে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানসহ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ হচ্ছিল। ফলে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে মোট ৩৫ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ‘আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়। ষড়যন্ত্রমূলক ও প্রহসনমূলক মামলার বিরুদ্ধে রাজপথ মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয়। ছাত্রদের বুকফাটা স্লোগানের প্রধান প্রতিধ্বনি হয়ে পৌঁছায় গ্রামে গঞ্জে। ১৯৬৮ সালে বিক্ষোভরত ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ করলে কিছু ছাত্র আহত ও নিহত হয়। ফলে প্রতিবাদ ব্যাপক বিস্তার লাভ করে ও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নও আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। ডাকসুর সহ-সভাপতি তোফায়েল আহম্মেদ ও ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া-মেনন এর নেতৃত্বে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি এ সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা সংবলিত একটি কর্মসূচি ঘোষণা করে।
ছাত্রদের ১১ দফা কর্মসূচি : আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে যখন ছাত্রনেতারা নেতৃত্ব দিচ্ছিল তখন ছাত্রসমাজের উপর গুলি চালানো হয়। এতে ছাত্রসমাজ আরো তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এজন্য ডাকসুর সহ-সভাপতি তোফায়েলের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ ছাত্র সংগ্রাম ১১ দফা দাবি জানায়। নিচে ১১ দফা কর্মসূচির নীতিমালা বর্ণনা করা হলো :
১. বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স, হামিদুর রহমান কমিশন ও জাতীয় শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, নারী শিক্ষার প্রসার, কারিগরি শিক্ষার প্রসার, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও
বাধ্যতামূলককরণ।
ক. স্কুল ও কলেজের সংখ্যাবৃদ্ধি করা;
খ. সরকারি কলেজগুলোতে নৈশ বিভাগ চালু;
গ. ছাত্র বেতন শতকরা ৫০% হ্রাস করা;
ঘ. শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি;
ঙ. পলিটেকনিক কনডেন্স কোর্স চালু;
চ. ছাত্রদের বিমানে, ট্রেনে ও বাস ভাড়া হ্রাস;
ছ. চাকরির সুযোগ সৃষ্টি ও চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান;
জ. বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ঘোষণা
২. ক. প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রদান;
খ. সংসদীয় গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা প্রদান;
গ. ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রদান;
ঘ. দৈনিক ইত্তেফাকের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ।
৩. ছয় দফা দাবির উপর ভিত্তি করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা।
৪. পশ্চিম পাকিস্তানে বেলুচিস্তান, সিন্ধু ও উত্তর প্রদেশ সীমান্ত প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন দানের পর পশ্চিম পাকিস্তানের সাব-ফেডারেশন গঠন করতে হবে।
৫.
ক. কৃষকের খাজনা ও ট্যাক্সের হার কমাতে হবে;
খ. বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ করতে হবে;
গ. সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল ও তহশিলদারদের অত্যাচার বন্ধ করতে হবে;
ঘ. পাট ও আখের ন্যায্য মূল্য প্রদান করা;
৬. ক. শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি প্রদান ও বোনাস প্রদান;
খ. বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা;
গ. শ্রমিকের স্বার্থবিরোধী কালো আইন বাতিল;
ঘ. ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার অধিকার।
৭, ব্যাংক, বিমা, পাট ব্যবসায় ও বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করতে হবে।
৮. পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. জরুরি অবস্থা, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার।
১০. ‘সিয়াটো’, ‘SEATO’, সেন্টো
নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করা।
‘CENTO’ এবং পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং স্বাধীন ও
১১. সকল রাজবন্দির মুক্তি দান, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার।
১১ দফা দাবির গুরুত্ব ও তাৎপর্য : ১১ দফা দাবির মধ্যে ৬ দফাভিত্তিক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথাই ছিল না এর সাথে সর্বজনীন ভোটাধিকার, প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি ৮টি বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ জোট গঠন করে। নিচে ১১ দফার দাবির গুরুত্ব ও
তাৎপর্য আলোচনা করা হলো :
১. সংসদীয় সরকার প্রবর্তন : ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের মুখে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। এতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়।
২. প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার : ১১ দফা দাবির মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের দাবি ছিল অন্যতম। ১১ দফা দাবির প্রেক্ষিতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রদান ও এর ভিত্তিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
৩. জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার : ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার জরুরি অবস্থা জারি করেছিল। ১১ দফার অন্যতম দাবি ছিল জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার। অবশেষে আইয়ুব খান জরুরি অবস্থা তুলে নিতে বাধ্য হয় ।
৪. সামরিক আদেশ বাতিল : ১১ দফা দাবির অন্যতম দাবি ছিল অগণতান্ত্রিক সকল প্রকার আদেশ বাতিল করা। অবশেষে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে সামরিক পন্থা বর্জন করে।
৫. নাগরিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা : ১১ দফা দাবির মাধ্যমে নাগরিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা ও চলাফেরার স্বাধীনতা লাভ করে সকল জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
৬. রাজবন্দির মুক্তিদান : ১১ দফার ১১নং দফা দাবি ছিল সকল রাজবন্দির মুক্তি দান। এতে মুজিবসহ ওয়ালী খান ও ৩৪ জন আসামিকে আইয়ুব সরকার বিনা শর্তে মুক্তি প্রদান করে।
৭. শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার : ১৯৬৯ এর ১১ দফা দাবির অন্যতম দাবি ছিল শ্রমিক ধর্মঘটের অধিকার। শ্রমিকের ন্যায্য দাবি আদায়ের উপায় হিসেবে ধর্মঘট করার অধিকার প্রদান করা হয় শ্রমিক ইউনিয়নকে।
৮. ফৌজদারি ১৪৪নং ধারা বাতিল : ১১ দফার মাধ্যমে ফৌজদারি দণ্ডবিধি ১৪৪নং ধারা বাতিল ঘোষণা করেন। এতে জনগণের দাবি ও আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হয়।
৯. রাজনৈতিক মামলা : ১১ দফা দাবির অন্যতম দাবি ছিল সকল প্রকার রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। এর ফলশ্রুতিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
১০. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা : আইয়ুব সরকার তার কুকীর্তি গোপন করতে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকা বাতিল ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ছাত্র সংগ্রামের মুখে ১১ দফা দাবি উত্থাপনের মধ্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দাবি করা হয়। ফলে আইয়ুব খান প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অধ্যাদেশ বাতিল ঘোষণা করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১১ দফা দাবি ছিল তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের। আইয়ুব সরকারের সামরিক শাসন, মনগড়া সংবিধান প্রণয়ন, জনগণের অধিকার খর্ব, নির্যাতন, নিপীড়ন, অত্যাচার ও মামলা-হামলার বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের ১১টি দাবি ছিল। এতে আইয়ুব সরকার বাধ্য হয়েছিল দাবিগুলো মানতে, কারণ এ দাবিগুলোর প্রেক্ষিতে আন্দোলন গণসমুদ্রে ও গণঅভ্যুত্থানের রূপ নিয়েছিল। এই ছাত্রসমাজের ১১ দফা দাবিই ছিল ১৯৭০ নির্বাচনের নির্বাচন ও পূর্ব বাংলার মানুষের সকল দাবি ফিরিয়ে আনার দাবি।