অথবা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা : বহু ত্যাগ, তিতীক্ষা ও আন্দোলনের ফলে ১৯৪৭ সালে বাংলা ব্রিটিশ অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পায়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ব্রিটিশ শাসন শোষণ থেকে মুক্তি পেলেও আবার পশ্চিমা প্রতিক্রিয়াশীল
শাসকগোষ্ঠীর শোষণে পতিত হয়। পশ্চিমা শোষণে বাংলার জনসাধারণের ক্ষোভের কারণে ঘটনা পরিক্রমায় সংঘটিত হয় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট : আমরা ইতিহাসের কার্যকারণ তত্ত্ব আলোচনায় দেখেছি যে, প্রতিটি ঘটনার জন্য কারণের উপস্থিতি ছিল। তাই ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের জন্যও একাধিক বিষয় আলোচনা করা দরকার। নিচে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সাথে জড়িত বিষয়াদির বিবরণ দেওয়া হলো :
১. ছয় দফার প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব : ৬ দফা কর্মসূচি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানি নেতারা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। দক্ষিণপন্থি দলগুলোও এর অপব্যাখ্যা করে আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিহ্নিত করেন। এদিকে ৬ দফা দিন দিন পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে জনপ্রিয়তা লাভ করতে লাগল। এ ৬ দফা আন্দোলনকে দমন করার জন্য পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন পন্থা গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নিজেই ৬ দফার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা ব্যবহার করার হুমকি দেন। তার নির্দেশে তাবেদার গভর্নর, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ কর্মীকে মামলায় জড়িত করে অযথা হয়রানি করেন। শেষপর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর কয়েকজন বিশিষ্ট কর্মীকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হলো (১৯৬৬/৮মে)।
২. পাকিস্তানি রাজনীতির বৈশিষ্ট্য : পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা যখনই তাদের ন্যায্য দাবি উত্থাপন করে, তখনই পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদীরা স্বার্থ রক্ষার জন্য হৈচৈ করে উঠেন এবং পূর্ব পাকিস্তানিদের শান্ত করার জন্য সর্বপ্রকার দমননীতি গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, দেশের অর্থনৈতিক তৎপরতার পশ্চাতে
সামরিক চক্রের অদৃশ্য খেলা সর্বদাই সক্রিয় ছিল। এ কারণেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের প্রবেশ ঘটতে পারেনি।
৩. ৬ দফা আন্দোলনকে চিরতরে দমন : পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ৬ দফা আন্দোলনকে দমন করার জন্য নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর প্রতিবাদে ৭ জুন সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। দেশের সর্বত্র নাগরিক জীবন স্তব্ধ হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানি সরকার জনগণের এ স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘটকে মেনে নিতে পারলেন না। ধর্মঘটি জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার
জন্য এ দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরীহ ছাত্র জনতার উপর গুলি বর্ষণ করা হয়। ফলে বহুলোক নিহত ও আহত হয়। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা এর প্রতিবাদ করেন।
৪. ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মধ্যে ভাঙন : জাতি যখন ৬ দফা পরবর্তী সংকটে পড়ে, তখন ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ এর মধ্যে বিভক্তি দেখা যায়। এর এক দলের নেতা মওলানা ভাসানী। অন্য দলের নেতা পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়ালি খান। ওয়ালি খান সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। পূর্ব পাকিস্তানে ওয়ালি ন্যাপের নেতা ছিলেন অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ। মুজাফফর আহমদ ৬ দফাকে সমর্থন করেননি। কিন্তু ভাসানীপন্থিরা বিরোধিতা করেন। ফলে ৬ দফা আন্দোলন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।
৫. আগরতলা মামলা : পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। এ সময় স্বৈরাচারী সরকার দেশদ্রোহিতার অজুহাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। অতঃপর শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা দায়ের করে কুমিল্লা সেনানিবাসে
আটক রাখেন। শাসকগোষ্ঠীর অভিযোগ ছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর অনুচরবর্গসহ ভারতের সাথে যোগাযোগ করে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বাঙালি জনসাধারণের কোনো ধারণা ছিল না। যাহোক, পরে বিচারের জন্য পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি এস.এ রহমানের নেতৃত্বে একটি বিশেষ আদালত গঠন করে ঢাকাতে বিচার শুরু হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে ষড়যন্ত্রের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার আগেই মামলা প্রহসনে পরিণত হয়।
৬. আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ : ১৯৬৮ সাল থেকে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দেয়। ১৯৬৪ সালের পর থেকে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে, তা আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে একজন ছাত্র হত্যাকে কেন্দ্র করে এ পুঞ্জীভূত অসন্তোষের আগুন জ্বলে উঠে। তরুণ ও ছাত্রসমাজ আইয়ুব সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলনের আওয়াজ তোলেন। আইয়ুব খান কর্তৃক পদচ্যুত পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেড এ ভুট্টো এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি পিপলস্ পার্টি গঠন করে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। কারাবাসের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। তার নেতৃত্বে প্রথম দিকে পশ্চিম পাকিস্তানে এ আন্দোলন নবজীবন লাভ করেছিল।
৭. উন্নয়ন দশক উদযাপন : ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান তার শাসনকালকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য উন্নয়ন দশক `উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ উৎসব পালনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যে, জনগণ এতে অংশগ্রহণ করেনি। সাধারণত মনে করা হয় যে, উন্নয়ন দশকের অপচয় এ সরকারের পতনকে আসন্ন করে তুলেছিল। জনগণের টাকা খরচ করে সরকারের পক্ষে ঢাকঢোল পিটানোর কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজমান ছিল, তা বিবেচনা করে পাকিস্তানিরা এতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
৮. গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন : দীর্ঘদিন থেকে পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক শাসন পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু জনগণের দাবি তারা সম্মিলিতভাবে পেশ করতে পারেনি বলে সফলকাম হয়নি। ১৯৬৯ সালে ৮ জানুয়ারি অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ ঢাকাতে মিলিত হয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত
গ্রহণ করেন। ন্যাপ ও পিপলস্ পার্টি ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল ৮ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের ঐক্য জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায়।
৯. ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন : গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পূর্বে পাকিস্তানের ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একাংশ নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় (১৯৬৯/৪ জানুয়ারি)। দেশে যখন নেতৃত্বের অভাব, তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী যে গণআন্দোলন শুরু হয়, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ১১ দফার ভিত্তিতে সে আন্দোলনে শরীক হয় এবং একে জোরদার করে তোলে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খান দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি যে অবিচার, নির্যাতন ও শোষণ চালিয়ে আসছিল তার পূর্ণ বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে।

ডিগ্রী অনার্স মাস্টার্স পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে পেতে Whatsapp এ ম্যাসেজ করুন। Whatsapp 01979786079