চার্বাক সম্প্রদায় কত প্রকার ও কী কী? বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, চার্বাক সম্প্রদায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, চার্বাক সম্প্রদায়ের প্রকারভেদ আলোচনা কর।
অথবা, চার্বাক সম্প্রদায়ের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
অথবা, চার্বাক সম্প্রদায়ের শ্রেণিবিন্যাস কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : উগ্র ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও অধ্যাত্মবাদের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদরূপে চার্বাক দর্শনের আবির্ভাব ঘটে। চার্বাক দার্শনিকরা অধ্যাত্মবাদের বিরোধী। অধ্যাত্মবাদের মূল কথা হলো আত্মা বা দেহমনের অতিরিক্ত এক অপরিবর্তনীয়, নিত্য চৈতন্য সত্তাই পরম সত্য। পরলোকের অস্তিত্ব, আত্মার অমরত্ব, কর্মফল লাভ এবং মোক্ষলাভ বা মুক্তিকে মানবজীবনের পরম লক্ষ্য বলে স্বীকার করে নেয় অধ্যাত্মবাদীরা। সুতরাং চার্বাকরা ভারতীয় দর্শনের মূল স্রোতের বিরোধী ।
চার্বাক দর্শন : ভারতীয় দর্শনে জড়বাদের সমার্থক হিসেবে চার্বাক কথাটিকে ব্যবহার করা হয়। চার্বাক দার্শনিকরা প্রত্যক্ষকে প্রকৃত জ্ঞানের উৎস হিসেবে স্বীকার করেন। শব্দ অনুমান প্রভৃতির মাধ্যমে যে পরোক্ষ জ্ঞান পাওয়া যায় তা নির্ভরযোগ্য নয়, কেননা তা প্রায়ই ভ্রান্ত হয়। তাই প্রত্যক্ষের মাধ্যমে প্রাপ্ত সাক্ষাৎ জ্ঞান ছাড়া অন্য কোন কিছুকেই সত্য বলে স্বীকার করা উচিত নয়। সুতরাং চার্বাকদের মতে, যা প্রত্যক্ষগোচর হয় তাই সত্য, আর যা প্রত্যক্ষগোচর নয় তা মিথ্যা। ভারতীয় দর্শনে চার্বাক দর্শন বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন। জড়বাদীরা আত্মা এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। চার্বাকরা পরলোকের অস্তিত্ব অস্বীকার করে। বৃহদারণ্যকে উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য এক জায়গায় মৈত্রেয়ীকে বলেছেন, জড় উপাদান থেকে উদ্ভুত হয়ে মানুষ আবার জড় উপাদনেই ফিরে যায়। মৃত্যুর পর মানুষের কোন চেতনা থাকে না। বস্তুত যাজ্ঞবন্ধ্যের উক্তির মাধ্যমে চার্বাকদের জড়বাদী আত্মার ধারণা ও পরলোকের অনস্তিত্বের বিষয়টি সূচিত হয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদেও বীরোচন নামক অসুরের বিভিন্ন উক্তিতে দেহাতিরিক্ত আত্মার ও পরলোকের অস্তিত্বের অস্বীকৃতি, আত্মসুখ প্রভৃতি চার্বাক মতবাদগুলোরই প্রকাশ ঘটেছে। চার্বাকরা বলেন, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা জড় জগৎকে প্রত্যক্ষ করি। এই জড়জগৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ এ চারিভূতের দ্বারাই গঠিত। চার্বাকগণের মতে, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র, বৃক্ষ, লতা, বিভিন্ন জীবদেহে প্রভৃতি জগতের যাবতীয় বস্তু, এমনকি মানবদেহও এ চারিভূতের সংযোগ দ্বারা সৃষ্ট এবং তাদের বিয়োগের দ্বারাই তারা বিনষ্ট হয়। চার্বাকগণ চেতনার অস্তিত্ব স্বীকার করেন। কারণ চেতনা দেহের ধর্ম এবং প্রত্যক্ষগ্রাহ্য।
চার্বাক সম্প্রদায় : চার্বাক দর্শনে তিনটি সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা :
১. আদি চার্বাক সম্প্রদায়,
২. ধূর্ত চার্বাক সম্প্রদায় ও
৩. সুশিক্ষিত চার্বাক সম্প্রদায়।
১. আদি চার্বাক সম্প্রদায় অনেকের মতে, চার্বাক মতের আদি প্রবর্তক হলেন আচার্য বৃহস্পতি। আদি চার্বাক সম্প্রদায় বৃহস্পতির উপদেশকে প্রমাণ বলে স্বীকার করতে রাজী ছিলেন না। আদি চার্বাক সম্প্রদায়ের নিজস্ব কোন মতবাদ ছিল না। কেবল পরমত খণ্ডন করাই ছিল এদের একমাত্র কাজ। এদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক। ঈশ্বর, পরলোক
প্রভৃতিতে এদের বিশ্বাস ছিল না। বেদকে এরা প্রামাণ্য বলে স্বীকার করতো না। এমনকি সর্বজনস্বীকৃত প্রত্যক্ষকেও এরা প্রমাণ বলে স্বীকার করতে রাজী নয়। এদের বক্তব্য হলো সংশয় বিপর্যয় রহিত অনুভবরূপ প্রমাণের সাহায্যে যে তত্ত্ব নির্ণয় হয় তাই যথার্থ তত্ত্ব। জয়রাশিভট্ট এ সম্প্রদায়ের একজন প্রধান সমর্থক। এ সম্প্রদায়ভুক্ত চার্বাকরা ছিলেন
সংশয়বাদী। এ সম্প্রদায়ভুক্ত চার্বাকরা নাস্তিক, বৈতণ্ডিক, হৈতুক, লোকায়ত, তত্ত্বোপপ্লববাদী প্রভৃতি বিভিন্ন নামে পরিচিত। সুতরাং আদি চার্বাক সম্প্র
দায়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সবকিছুতেই সন্দেহ উৎপাদন করা।
২. ধূর্ত চার্বাক সম্প্রদায় : চার্বাক সম্প্রদায় বলতে যে সম্প্রদায়কে বুঝানো হয় সে সম্প্রদায় হলো ধূর্ত চার্বাক সম্প্রদায়। আদি চার্বাক সম্প্রদায়ের নেতিবাচক দিক দ্বারা কোন দার্শনিক মত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই ধূর্ত চার্বাকগণ স্বীকার করলেন যে, প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। কিন্তু এই সম্প্রদায় প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করলেও শব্দ, অনুমান, উপমান প্রভৃতি অন্য কোন প্রমাণকে প্রমাণ বলে স্বীকার আত্মার অস্তিত্ব নেই। ইন্দ্রিয় সুখই পরম কাম্য। ঈশ্বর, পরলোক বা জন্মান্তরে এরা বিশ্বাস করে না। এ সম্প্রদায় না। এদের মতে, দেহাতিরিক্ত কোন কার্যকারণ সম্বন্ধ এবং কর্মফল স্বীকার করে না। স্বর্গ, নরক প্রভৃতির কোন প্রকৃত অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। দৈহিক ও ক্ষণিক সুখই স্বর্গ, কণ্টকাদি ব্যথাজনিত দুঃখই নরক। ধূর্ত সম্প্রদায় স্থূল চার্বাক, উচ্ছেদবাদী, দেহাত্মবাদী প্রভৃতি নামেও পরিচিত।
৩. সুশিক্ষিত চার্বাক সম্প্রদায় : সুশিক্ষিত চার্বাক সম্প্রদায় প্রত্যক্ষ ছাড়া অনুমানকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেন। চার্বাকরা বলেন, যে অনুমানের উপর ভিত্তি করে ঈশ্বর পরলোক, স্বর্গ, নরক, কর্মফল, পুনর্জন্ম প্রভৃতির অস্তিত্ব মেনে নেয়া যায়, সেরূপ অনুমানের প্রামাণ্য স্বীকার করেন না। এ সুশিক্ষিত চার্বাকগণ অর্থ এবং কাম এ উভয়কেই পুরুষার্থ বলে গণ্য করেছেন। অথর্ববেদ এবং গান্ধর্ববেদের প্রামাণ্য এরা স্বীকার করেছেন। ধূর্ত চার্বাক সম্প্রদায়ের মধ্যে এদের পার্থক্য হলো, ধূর্ত চার্বাক সম্প্রদায় মনে করে ক্ষণিক স্থূল দৈহিক সুখই মানুষের একমাত্র কাম্যবস্তু। কিন্তু সুশিক্ষিত চার্বাক সম্প্রদায়ের মতে, ক্ষণিক স্থুল পশু সুলভ দৈহিক সুখের পরিবর্তে পবিত্র সুস্থ মানসিক সুখই মানুষের পুরুষার্থ বা একমাত্র কাম্যবস্তু। এ সম্প্রদায়ের দার্শনিকদের মধ্যে কেউ কেউ দেহের পরিবর্তে ইন্দ্রিয়কে, কেউ মনকে, কেউ আবার প্রাণকে আত্মা বলেছেন। এরা ক্রমশ অধ্যাত্মবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। তাই দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী তাঁর চার্বাক দর্শনগ্রন্থে এমতই ব্যক্ত করেছেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আদি চার্বাক সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল নাস্তিক এবং সংশয়বাদী। তাদের নিজস্ব কোন মতামত ছিল না। ধূর্ত চার্বাক সম্প্রদায়রা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে মনে করেন। আবার সুশিক্ষিত চার্বাক সম্প্রদায়রা প্রত্যক্ষ ছাড়া অনুমানকেও প্রমাণ বলে স্বীকার করেন। সুতরাং চার্বাক সম্প্রদায়ের গুরুত্বকে ভারতীয় দর্শনে একেবারে অস্বীকার করা যায় না।