অথবা, চার্বাক নীতিদর্শন ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
অথবা, চার্বাক নীতিদর্শন ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা :
চার্বাক দর্শন বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন। চার্বাক দর্শনের মতে, অচেতন জড়পদার্থই একমাত্র সত্তা। চার্বাক দর্শন নিছক জড়বাদী বলে তা আত্মা এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। জড়বাদী দার্শনিক চিন্তার উপরই চার্বাক নীতিতত্ত্বের ভিত্তি। নীতিতত্ত্বের অন্যতম আলোচ্যবিষয় জীবনের পরম কাম্য বস্তু বা পুরুষার্থ কি? চার্বাকরা কাম এবং অর্থকে একমাত্র পুরুষার্থ মনে করেন। চার্বাকদের নীতিতত্ত্বকে সুখবাদ বলা হয়।
চার্বাক নীতিতত্ত্ব : ‘চার্বাক নীতিতত্ত্ব নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ইন্দ্রিয় সুখ ভোগই জীবনের উদ্দেশ্য : চার্বাকদের মতে, সুখ ভোগেই জীবনের পরম কাম্যবস্তু বা পুরুষার্থ। তারা আরো বলেছেন, ইন্দ্রিয় সুখই জীবনে পরম কল্যাণ বা পুরুষার্থ, জগতের যত রকমের সুখ আছে, তন্মধ্যে ইন্দ্রিয় সুখই শ্রেষ্ঠ এবং ধ্রুব। চার্বাকরা মনে করেন, দেহের বিনাশেই চেতনার বিনাশ এবং যেহেতু আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই, সেহেতু মৃত্যুর পরে স্বর্গসুখ ভোগের প্রশ্নই উঠে না। সুতরাং পার্থিব সুখই স্বর্গ এবং পার্থিব দুঃখই নরক।
২. মোক্ষ বা মুক্তি মানুষের পরম পুরুষার্থ নয় : ভারতীয় দার্শনিকদের অনেকেই মোক্ষ বা মুক্তিকে মানুষের পরম পুরুষার্থ বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, শুধু মৃত্যুর পর আত্মা দেহ মুক্ত হলেই মোক্ষলাভ হতে পারে, আবার কেউ কেউ বলেছেন, জীবিতাবস্থায়ও মোক্ষলাভ সম্ভব। কিন্তু চার্বাকগণ কোন মতকেই গ্রহণ করেন নি। তাঁদের মতে, মোক্ষবাদ, উপহাসের বিষয় মাত্র। কারণ যে আত্মা মৃত্যুতে দেহের সাথে বিনষ্ট হয়ে যায়, মৃত্যুর পরে সে আত্মার মোক্ষলাভ কি করে সম্ভব হয়? আবার জীবিতাবস্থায়ও সম্ভব নয়, কারণ জীবিতাবস্থায় দুঃখের নিবৃত্তি সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার। সুখদুঃখ মিলেই মানুষের জীবন। আমরা সাধ্যমতো দুঃখকে পরিহার করার চেষ্টা করতে পারি এবং যত অধিক পরিমাণে সুখ ভোগ করা যায় তার জন্য সচেষ্ট হই । চার্বাকদের মতে, মৃত্যুতেই কেবলমাত্র দুঃখের অত্যন্তিক নিবৃত্তি সম্ভব।
৩. অবিমিশ্র সুখ ভোগ সম্ভব নয় : চার্বাকদের মতে, এ জগতে অবিমিশ্র সুখ ভোগ সম্ভব নয় সত্য, কিন্তু জাগতিক সুখের সাথে দুঃখ মিশে আছে বলে সুখ অন্বেষণ থেকে বিরত হওয়া মূর্খতারই সামিল। দুঃখ মিশ্রিত বলে ভোগের জন্য সুখকে উপেক্ষা করা সমীচীন নয়। যা সুখের সাথে এসে পড়ে অথচ তা অবর্জনীয়, সেরূপ দুঃখকে স্বীকার করে নিয়েই.সুখকে ভোগ করতে হবে। যদিও সুখ ভোগ করতে হলে দুঃখ ভোগ অপরিহার্য, তথাপি তাকে যথাসম্ভব পরিহার করে সুখ ভোগ করাই বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্তব্য। তাছাড়া চার্বাকরা বলেছেন যে, দুঃখ আছে বলেই সুখের এত মাধুর্য, অন্ধকার আছে বলেই আলোর এত কদর, বিচ্ছেদ আছে বলেই মিলন এত মধুর।
৪. স্বর্গ, আত্মা, পারলৌকিক এসব সত্য নয় : চার্বাকগণ বলেছেন, পরলোক বা মুক্তাবস্থা, স্বর্গ এসব ধূর্ত ব্রাহ্মণগণের অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে নিজেদের জীবিকা অর্জনের জন্য ব্রাহ্মণগণ মানুষকে দান ধর্ম, যাগযজ্ঞ প্রভৃতি অনুষ্ঠান করতে উপদেশ দিয়েছেন। এভাবে চার্বাকগণ বৈদিক আচার- অনুষ্ঠানের কঠোর সমালোচনা করেছেন ।
৫. অর্থ এবং কামই পুরুষার্থ : কোন কোন ভারতীয় দার্শনিক অর্থ, কাম, ধর্ম ও মোক্ষ এ চারটিকে জীবনের একমাত্র কাম্যবস্তু বা পুরুষার্থ বলে অভিহিত করেছেন। চার্বাকগণ মোক্ষ এবং ধর্মকে পুরুষার্থ বলে স্বীকার করতে নারাজ। চার্বাকগণ কাম বা সুখ এবং অর্থ দুটিকেই পুরুষার্থ বলে মনে করেন। সুতরাং চার্বাকদের মতে, কামই হচ্ছে চরম লক্ষ্য। অর্থাৎ ভালো এজন্য যে তা কাম বা আনন্দের সহায়ক।
৬. যত বেশি সুখ ভোগ সম্ভব মানুষের তা করা উচিত : চার্বাকগণ বলেছেন, অতীত চলে গেছে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, কেবল বর্তমানই মানুষের আয়ত্তে আছে। তাই যেভাবেই হোক বর্তমান জীবনে মানুষ যত বেশি সুখ ভোগ করতে পারে তাদের তা করা উচিত। তাদের উপদেশ, ঋণ করে হলেও ঘি খাবে, যত দিন বাঁচবে সুখে বাঁচবে। চার্বাকদের নৈতিক
মতবাদকে সুখবাদ বলা হয়। কারণ তাদের মতে, যে কাজ অধিক সুখ দেয় সে কাজই সৎ, আর যে কাজ দুঃখ দেয় তাই অসৎ কাজ।
সমালোচনা : চার্বাক নীতিতত্ত্ব বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। চার্বাক নীতিতত্ত্বের সমালোচনাসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. নৈয়ায়িক উদয়ন চার্বাকদের বেদের নিন্দার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার জন্য পুরোহিতরা বেদ সৃষ্টি করেন নি, বরং বেদ সেসব সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের রচনা, যারা চারিত্রিক সততা, মহানুভবতা, নিঃস্বার্থপরতা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য সুপরিচিত ছিল। সুতরাং নৈয়ায়িক উদয়ন বলেছেন, এ জাতীয় অসাধারণ ভাবাপন্ন ব্যক্তিদের রচিত বেদ সব সংশয়ের ঊর্ধ্বে। যেসব মানবিক মূল্য মানুষের জীবনকে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে সেগুলোকে চার্বাকরা অস্বীকার করেছেন। মূল্য বর্জিত মানবজীবন পশুর সমতুল্য। তাকে যথার্থ মানব দর্শন নামে অভিহিত করা চলে না।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, চার্বাক দর্শন চরম প্রত্যক্ষবাদী ও সংশয়বাদী। চার্বাক দর্শন একটু বেশি উত্তেজনাপ্রবণ এবং অসংযত ছিল বলে প্রচলিত মূল্যবোধ এবং পুরোহিত শ্রেণীকে মারাত্মকভাবে আঘাত করে বলেই সম্ভবত এ দর্শন বেশি অনাদৃত হয়েছে। অন্যদিকে, চার্বাক দর্শন স্বাধীন চিন্তাধারার পথ উন্মুক্ত করেছে এবং নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে ভারতীয় দর্শনকে পুষ্ট করেছে। আধুনিক পণ্ডিতদের কাছে তাই এ দর্শন বেশ

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%9a%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%8d/
admin

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!