চার্বাক নীতিতত্ত্বকে সুখবাদ বলা হয় কেন?
অথবা, চার্বাক নীতিতত্ত্বে সুখভোগের দিকটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ‘সুখভোগই চার্বাক নীতিতত্ত্বের মূলকথা’-সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : চার্বাক দর্শন বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন। চার্বাক দর্শনের মতে, অচেতন জড়পদার্থই একমাত্র সত্তা। চার্বাক দর্শন নিছক জড়বাদী বলে তা আত্মা ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। জড়বাদী দার্শনিক চিন্তার উপরই চার্বাক নীতিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত । চার্বাক নীতিতত্ত্বের অন্যতম আলোচ্যবিষয়। জীবনের পরম কাম্যবস্তু বা মানুষের পুরুষার্থ ।
চার্বাক নীতিতত্ত্ব : গতানুগতিক নীতিবিদ্যার মত চার্বাক নীতিতত্ত্ব কোন নীতি-নৈতিকতার প্রচার বা নৈতিক আলোচনায় ব্যাপৃত নয়। জাগতিক সুখ ভোগ তাদের প্রধান কাম্য। কাজেই সুখ ভোগের জন্য নির্ধারিত কর্মনীতিই চার্বাক নীতিতত্ত্ব। চার্বাক নীতিতত্ত্বকে তাই সুখবাদ বলা হয়।
জীবনের উদ্দেশ্য : চার্বাকদের মতে, সুখ ভোগই জীবনের পরম কাম্যবস্তু। তাদের মতে, জগতে যত রকমের সুখ আছে, তার মধ্যে ইন্দ্রিয় সুখই শ্রেষ্ঠ এবং ধ্রুব।
স্বর্গসুখ অবান্তর : চার্বাকরা মনে করেন, দেহের বিনাশেই চেতনার বিনাশ এবং আত্মার যেহেতু কোন অস্তিত্ব নেই, সেহেতু মৃত্যুর পর স্বর্গসুখ ভোগের প্রশ্নই উঠে না। সুতরাং চার্বাক মতে, পার্থিব সুখই স্বর্গ এবং পার্থিব দুঃখই নরক।অতিপ্রাকৃত জগতের স্বর্গ-নরক এবং পার্থিব দুঃখই নরক। অতিপ্রাকৃত জগতের স্বর্গ-নরক বলে কিছু নেই।
মানুষের পরম পুরুষার্থ : পরম পুরুষার্থ হিসেবে চার্বাকরা মোক্ষ বা দুঃখ হতে মুক্তি লাভের বিষয়টিকে মেনে নেন নি। তাঁদের
মতে, মোক্ষবাদ উপহাসের বিষয়মাত্র। কারণ যে আত্মা মৃত্যুর সাথে সাথে বিনষ্ট হয়ে যায় তার মোক্ষলাভের প্রশ্নই আসে না।
অবিমিশ্র সুখ : চার্বাকদের মতে এ জগতে অবিমিশ্র সুখ ভোগ সম্ভব নয়। কিন্তু জাগতিক সুখের সাথে দুঃখ মিশে আছে বলে সুখ অন্বেষণা থেকে বিরত হওয়াকে তারা মূর্খতা বলেছেন। দুঃখ মিশ্রিত বলে ভোগের জন্য সুখকে উপেক্ষা করা সমীচীন নয়।
সুখ এবং অর্থই পুরুষার্থ : চার্বাকগণ মোক্ষ এবং ধর্মকে পুরুষার্থ বলে স্বীকার করতে নারাজ। চার্বাকগণ কাম বা সুখ এবং অর্থ দুটিকেই পুরুষার্থ বলে মনে করেন। চার্বাকদের মতে, সুখই হচ্ছে চরম লক্ষ্য। তাদের মতে, সুখ ভালো এজন্য যে তা কাম বা আনন্দের সহায়ক।
মানুষের উচিত সর্বোচ্চ সুখ ভোগ করা : চার্বাক মতে, অতীত ও ভবিষ্যৎ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কেবল বর্তমানই তার আয়ত্বে আছে। তাই যেভাবেই হোক বর্তমান জীবনে মানুষ যত বেশি সুখ ভোগ করতে পারে তাদের তা করা উচিত। কারণ তাদের মতে, যে কাজ অধিক সুখ দেয় সে কাজই সৎ, আর যে কাজ দুঃখ দেয় সেটি অসৎ কাজ।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, চার্বাক দার্শনিকরা ইন্দ্রিয় সুখের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ইন্দ্রিয় সুখ ভোগের জন্য যা করা উচিত তারা তাই করার পরামর্শ দিয়েছেন। যে কাজ ইন্দ্রিয় সুখ প্রদান করে সেটি তাদের কাছে সর্বোত্তম কাজ। কিছু কিছু বিষয়ের সাথে দুঃখ মিশ্রিত থাকলেও সুখের কথা বিবেচনা করে তারা তা গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থাৎ যেখানেই সুখের হাতছানি আছে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ার নীতিতে চার্বাকরা বিশ্বাসী ছিলেন। তাই চার্বাক নীতিতত্ত্বের আরেক নাম সুখবাদ।