General Knowledge

চার্বাক জ্ঞানতত্ত্বের একটি সমালোচনামূলক ব্যাখ্যা দাও।

অথবা, চার্বাক জ্ঞানতত্ত্বের ব্যাখ্যা মূল্যায় কর।
অথবা, চার্বাক দর্শন কী? চার্বাক জ্ঞান তত্ত্ব আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
চার্বাক দর্শন বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন। চার্বাক দর্শনের মতে, অচেতন জড়পদার্থই একমাত্র সত্তা। চার্বাক দর্শন নিছক জড়বাদী বলে এটা আত্মা এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। চার্বাক দর্শন সম্পর্কে কোন প্রামাণিক গ্রন্থ পাওয়া যায় নি। তবুও এ দর্শন যে অতি প্রাচীন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে, এ নিয়ে মতভেদ দেখা যায়। কারো মতে, পুরাকালে চার্বাক নামে কোন এক ঋষি ছিলেন। তিনিই এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। আবার কেউ কেউ চর্ব ধাতু থেকে চার্বাক শব্দের উৎপত্তি বলে মনে করেন। চার্বাক শব্দের অর্থ যাহোক, আর যিনিই এ দর্শন প্রতিষ্ঠা করুন না কেন, চার্বাক দর্শন বলতে জড়বাদী নাস্তিক দর্শনকেই বুঝায়। চার্বাকরা জ্ঞান সম্পর্কে যা বলেছেন তা দর্শনের ইতিহাসে চার্বাকদের জ্ঞানতত্ত্ব নামে পরিচিত। চার্বাকদের জ্ঞানতত্ত্বের উপরই তাদের সমগ্র দর্শন প্রতিষ্ঠিত।
চার্বাকদের জ্ঞানতত্ত্ব : চার্বাকদের মতে, যথার্থ জ্ঞান লাভের উপায় হলো প্রমাণ। চার্বাক দর্শনের মতে, প্রত্যক্ষণই (Perception) একমাত্র প্রমাণ। অর্থাৎ ‘প্রত্যক্ষই’ যথার্থ জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায়। যে বস্তুকে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায় না, সে বস্তুর অস্তিত্ব আছে, এ কথা বলা অর্থহীন। প্রত্যক্ষ দুই প্রকার। যথা :
১. বাহ্য প্রত্যক্ষ : চোখ, কান, নাক, জিহ্বা এবং ত্বক এ পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বহির্বস্তুর যে সাক্ষাৎ জ্ঞান তাই ‘বাহ্য প্রত্যক্ষ।
২. মানস প্রত্যক্ষ : মনরূপ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সুখ, দুঃখ প্রভৃতি মানসিক অবস্থার যে সাক্ষাৎ জ্ঞান লাভ করা হয় তাকেই মানস প্রত্যক্ষ বলা হয়। চার্বাক দর্শন অনুমান (Inference) এবং শব্দকে (Testimony) প্রমাণরূপে গ্রহণ করে নি। কারণ তাঁদের মতে, অনুমান এবং শব্দের দ্বারা কোন সন্দেহাতীত ও যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না। অনুমান এবং শব্দকে প্রমাণরূপে গ্রহণ করার বিরুদ্ধে চার্বাকগণ নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো প্রদর্শন করেন :
ক. অনুমান প্রমাণের বিরুদ্ধে চার্বাকদের আপত্তি : অনুমান প্রমাণের বিরুদ্ধে চার্বাকদের আপত্তি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ব্যাপ্তি জ্ঞান নির্ভরযোগ্য নয় : চার্বাকদের মতে, ব্যাপ্তি জ্ঞান নির্ভরযোগ্য নয়। একটি অনুমানের প্রতি দৃষ্টি দিলে বিষয়টি বুঝা সহজসাধ্য হবে। দূরস্থ কোন পর্বতে ধোঁয়া দেখে অনুমান করা হলো উক্ত পর্বতে অগ্নি আছে। এ অনুমানটিতে ‘পর্বত’ হলো পক্ষপদ ‘অগ্নি’ হলো সাধ্যপদ এবং ধোঁয়া হলো হেতুপদ। এ অনুমানটিকে যুক্তিতে রূপ দিলে নিম্নরূপ হবে :
যেখানে ধোঁয়া আছে সেখানেই আগুন থাকে; পর্বতটিতে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে; সুতরাং পর্বতটিতে আগুন আছে।
২. নিয়ত সম্বন্ধ প্রত্যক্ষ গোচরীভূত নয় : চার্বাকরা বলেছেন, দুটি বস্তু পাশাপাশি অবস্থান করলেই তাদের মধ্যে নিয়ত সম্বন্ধ আছে, একথা প্রমাণিত হয় না। যেমন- ধোঁয়া ও আগুন পাশাপাশি থাকলে তাদের প্রত্যক্ষ করা চলে কিন্তু তাদের সম্বন্ধকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। সুতরাং এ সম্বন্ধ সন্দেহাত্মক।
৩. নিয়ত সম্বন্ধ সার্বিকভাবে সত্য নয় : কোন নিয়ত সম্বন্ধ যে সার্বিকভাবে সত্য হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ বর্তমানে ধোঁয়ার সাথে আগুনের নিয়ত সম্বন্ধ প্রত্যক্ষগোচর হলেও অতীতে সে সম্বন্ধ হয়ত ছিল না এবং ভবিষ্যতে তা নাও থাকতে পারে।
৪. ব্যাপ্তি জ্ঞান অনুমান নির্ভর নয় : চার্বাকদের মতে, ব্যাপ্তি জ্ঞান কোন অনুমান হতে পারে না। কারণ যদি কোন জ্ঞান অনুমানের উপর নির্ভর করে তবে সে অনুমানের ব্যাপ্তিকে আবার আরেকটি অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়।
এভাবে অনুমানের অনুমান করতে থাকল ে অনবস্থা দোষ (Infinite regress) ঘটবে।
৫. আপ্ত পুরুষের বাক্য সন্দেহাতীত নয় : ব্যাপ্তি জ্ঞান যদি কোন আপ্ত পুরুষের বাক্যের উপর নির্ভর করে, তবে সে ব্যাপ্তি জ্ঞান সন্দেহাতীত নয়। কারণ বিশ্বাসযোগ্য আপ্ত পুরুষের মাধ্যমে প্রাপ্ত অনুমানলব্ধ জ্ঞান সন্দেহ মুক্ত নয়। আর সন্দেহের উপর নির্ভরশীল কোন জ্ঞান সন্দেহাতীত নয়।
৬. অনুমানলব্ধ জ্ঞান সুস্পষ্ট নয়: অনুমানলব্ধ জ্ঞান প্রত্যক্ষের মতো সুস্পষ্ট নয়। অনুমান নিজে যদি অস্পষ্ট হয়, তবে সে কি করে আমাদের স্পষ্ট জ্ঞান দেবে? সুতরাং অনুমান যথার্থ জ্ঞান দিতে পারে না।
৭. অনুমানলব্ধ জ্ঞান সরাসরি নয় : চার্বাকরা আরো বলেছেন, অনুমানলব্ধ জ্ঞান বস্তু হতে সরাসরি আসে না। এটি আসে অন্য জ্ঞানের মাধ্যমে। অনুমানের জ্ঞানকে যথার্থ জ্ঞান বলা চলে না। সুতরাং অনুমানকেও যথার্থ প্রমাণরূপে গ্রহণ করা যায় না।
খ. শব্দ প্রমাণের বিরুদ্ধে চার্বাকদের আপত্তি : ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়কে অনেকে শব্দ বা আপ্তবাক্যকে একটি যথার্থ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু চার্বাকদের মতে, শব্দ নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নয়। কারণ শব্দ হলো বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির বচন মাত্র। কোন ব্যক্তি বিশ্বাসযোগ্য কি না তা অনুমান করা হয় তার চরিত্র হতে। অনুমান যেখানে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নয়, সেখানে অনুমান নির্ভর শব্দকেও যথার্থ প্রমাণরূপে গ্রহণ করা যায় না। অতএব চার্বাকগণের মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ, অনুমান বা শব্দ কোনটাই যথার্থ প্রমাণ নয়।
সমালোচনা : চার্বাকদের জ্ঞানতত্ত্ব নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হলো :
১.চার্বাকদের মতে, অনুমান ও শব্দজ্ঞান কোন কোন সময় ভুল প্রমাণিত হয় এবং মানুষকে প্রতারিত করে। তাই
২.এদের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। কিন্তু প্রত্যক্ষ জ্ঞানও কোন কোন সময় ভুল প্রমাণিত হয় এবং মানুষকে প্রতারিত করে। যেমন- আমরা পৃথিবীকে স্থির দেখি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি সূর্যের চারদিকে ঘুরছে।
সুতরাং চার্বাকদের অনুমান ও শব্দকে প্রমাণরূপে প্রত্যাখ্যান করে প্রত্যক্ষকে প্রমাণরূপে গ্রহণ করার পশ্চাতে কোন যুক্তি নেই ।
৩. চার্বাকদের মতে, অনুমানলব্ধ জ্ঞান পরোক্ষ, তাই এটি অসম্পূর্ণ। এজন্য অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা। যায় না। কিন্তু জৈনরা বলেছেন, পরোক্ষ জ্ঞানের মতো প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান সরাসরি নয়। কেননা পঞ্চইন্দ্রিয়ের
মাধ্যমে আমরা এ জ্ঞান পাই। চার্বাকদের’ মতে, অনুমানলব্ধ জ্ঞান অস্পষ্ট, তাই একে গ্রহণ করা যায় না। কিন্তু জৈনরা বলেছেন, স্পষ্টতা
প্রমাণের লক্ষণার্থ নয়। আর যা স্পষ্ট তা যথার্থ একথাও বলা চলে না। কেননা বহু স্পষ্ট প্রত্যক্ষ আছে ভ্রান্ত ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, চার্বাকদের মতবাদের যথেষ্ট ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এ মতবাদকে কোনক্রমেই গুরুত্বহীন বলা যায় না। কেননা সবকিছুরই ভালোমন্দ দুটি দিক থাকে। আর সাধারণত সমালোচকরা মন্দ দিকটাই সমালোচনা করে থাকেন। তবে সমালোচকদের ভাষ্য থেকে আমরা চার্বাকদের বক্তব্যকে ধারণা করে নেই মাত্র। অবশ্য একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভারতীয় দর্শনে চার্বাক দর্শনই সর্বপ্রথম অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এর ফলে ভারতীয় দর্শন বিচার বিযুক্তবাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। কাজেই চার্বাক দর্শন জড়বাদী হলেও ভারতীয় দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে এর অবদান অস্বীকার করা যায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!