চার্বাক জড়বাদ ও পাশ্চাত্য জড়বাদের মধ্যে সম্পর্ক ও পার্থক্য লেখ।
অথবা, চার্বাক জড়বাদ ও পাশ্চাত্য জড়বাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য নির্ণয় কর।
অথবা, চার্বাক জড়বাদ ও পাশ্চাত্য জড়বাদের মধ্যে মিল ও অমিল খুঁজে বের কর।
অথবা, চার্বাক বস্তুবাদ ও পাশ্চাত্য বস্তুবাদের মধ্যে সম্পর্ক ও পার্থক্য লিখ।
অথবা, চার্বাক বস্তুবাদ ও পাশ্চাত্য বস্তুবাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতের দার্শনিক চিন্তাধারার মধ্যে আধ্যাত্মবাদ অন্যতম। আবার আধ্যাত্মবাদের চিন্তাধারায় বিরোধী চিন্তাধারাও পরিলক্ষিত হয়। জড়বাদ হচ্ছে আধ্যাত্মবাদের বিরোধী মতবাদ। ভারতীয় দর্শনে এ জড়বাদের প্রচার করেছেন চার্বাক দার্শনিকরা। জড়বাদ আত্মা, ঈশ্বর প্রভৃতি অতীন্দ্রিয় তত্ত্বের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। চার্বাক দর্শন যেহেতু জড়কেই একমাত্র তত্ত্ব বলে মনে করে, সেহেতু চার্বাক দর্শন জড়বাদের প্রচারক।
চার্বাক জড়বাদ : ভারতীয় দর্শনে চার্বাক জড়বাদীরা উল্লেখ করেন যে, জড়বস্তুই জগতের আদিসত্তা। জড় থেকেই জগৎ তথা এর অন্তর্নিহিত সবকিছুর উদ্ভব। কারণ জড়ই একমাত্র প্রত্যক্ষগোচর। জড় ভিন্ন অন্য কোন বস্তু প্রত্যক্ষগোচর নয়। চার্বাকরা জড়ের উপর ভিত্তি করেই তাদের দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। জড়বাদী ব্যাখ্যার চার্বাক দার্শনিকরা মাটি, পানি, আগুন এবং বায়ুকেই মৌলিক পদার্থ বলে স্বীকার করে নেয়। তাদের মতে, প্রত্যক্ষিত বস্তুই অস্তি ত্বশীল। আকাশকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। তাই আকাশ পদার্থ বলে স্বীকৃত নয়। ন্যায় বৈশেষিকরা আকাশকে একটি ভাব পদার্থ বলে স্বীকার করে নিলেও চার্বাকরা বলেছেন যে, অনুমান সাপেক্ষ কোন দ্রব্যকে নিত্য বলে স্বীকার করা যায় না।
চার্বাক জড়বাদ ও পাশ্চাত্য জড়বাদের মধ্যে সাদৃশ্য : চার্বাক জড়বাদ ও পাশ্চাত্য জড়বাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। নিম্নে এই সম্পর্কসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. উভয় মতবাদই প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ বলে মনে করে। উভয়ের মতে, প্রত্যক্ষিত বস্তু একমাত্র অস্তিত্বশীল।
২. উভয় মতবাদেই ইচ্ছার স্বাধীনতার বিপক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছে।
৩. উভয় মতবাদই মনে করে জড় থেকেই জগৎ, প্রাণ, মন তথা এর অন্তর্নিহিত সবকিছুর উৎপত্তি হয়েছে।
৪. উভয় মতবাদেই উল্লেখ করা হয় যে, জগতের সৃষ্টির পিছনে কোন উদ্দেশ্যও পরিণতি নেই।
৫. উভয় মতবাদেই ঈশ্বর, আত্মা, স্বর্গ, নরক, পরলোক প্রভৃতি অতীন্দ্রিয় বিষয়কে অস্বীকার করা হয়।
৬. উভয় মতবাদেই ধর্মকে অলীক ও কল্পনা বলে মনে করা হয় এবং বলা হয় ধর্ম হলো রুটি, রুজি ও সুবিধা বাদীদের স্বার্থসিদ্ধির একটা দর্শন।
চার্বাক জড়বাদ ও পাশ্চাত্য জড়বাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্য : চার্বাক জড়বাদ ও পাশ্চাত্য দর্শনের মধ্যে সাদৃশ্য ছাড়া কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো :
১. পাশ্চাত্য জড়বাদ কার্যকারণকে স্বীকার করে। কিন্তু চার্বাক জড়বাদ কার্যকারণকে অস্বীকার করে।
২. পাশ্চাত্য জড়বাদে শক্তির নিত্যতা নিয়মের সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে। কিন্তু চার্বাক জড়বাদে এ ধরনের কথা উল্লেখ থাকে না।
৩. পাশ্চাত্য জড়বাদে যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু চার্বাক জড়বাদে এমন কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।
৪. পাশ্চাত্য জড়বাদে কেবল জড়কেই একমাত্র উপাদান বলে প্রমাণ করা হয়। কিন্তু চার্বাক জড়বাদে মাটি, পানি, আগুন ও বায়ু এ চারটি মৌলিক উপাদানের কথা উল্লেখ করা হয়।
৫. চার্বাক জড়বাদে স্বজ্ঞবাদ, দেহাত্মবাদ, দৃষ্টিবাদ ও বস্তুবাদ সম্পৃক্ত। কিন্তু পাশ্চাত্য জড়বাদী ব্যাখ্যায় এ ধরনের কোন মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায় না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, চার্বাক দর্শন জড়বাদী দর্শন। চার্বাক দর্শনের সাথে পাশ্চাত্য দর্শনের বৈসাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও অনেকাংশে সাদৃশ্যও ব
র্তমান রয়েছে। উভয় মতবাদই মনে করে যে, জড় থেকেই জগৎ তথা এর অন্তর্নিহিত সবকিছুর উৎপত্তি হয়েছে। সুতরাং চার্বাক দর্শনে চার্বাক ও পাশ্চাত্য দর্শনের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।