গৌতম বুদ্ধের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা কর।
অথবা, গৌতম বুদ্ধের জীবনী আলোচনা কর।
অথবা, গৌতম বুদ্ধ কে ছিলেন? বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : গৌতম বুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দ) ছিলেন সত্যদ্রষ্টা সাধক। তিনি মানুষের জীবনের দুঃখদুর্দশার হাত থেকে কিভাবে চিরমুক্তি লাভ করা যায় সে জ্ঞান লাভের আশায় দীর্ঘদিন সাধনা করেছিলেন। তিনি নিজের আত্মশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে বহু বছর কঠোর তপস্যা করে জগতে দুঃখের রহস্য ও স্বরূপ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। দুঃখের রহস্য সম্পর্কিত সম্যক জ্ঞান লাভই গৌতমের বুদ্ধত্ব লাভ এবং এ দিন থেকেই তিনি বুদ্ধ বা সম্যক জ্ঞানী নামে খ্যাত হন। গৌতম বুদ্ধের বাণী এবং উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ এবং জীবন
সম্পর্কিত যে দার্শনিক মতবাদ গড়ে উঠেছে সে মতবাদই বৌদ্ধদর্শন।
১. গৌতম বুদ্ধের পরিচয় : খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩, মতান্তরে ৫৬৭ অব্দে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব হয়। হিমালয়ের পাদদেশে (অধুনা নেপালের অন্তঃপাতি) কপিলাবস্তু নগরে শাক্য বংশীয় এক রাজপরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কূলগত নাম ‘শাক্য সিংহ’, গোত্র নাম গৌতম এবং পিতৃদত্ত নাম সিদ্ধার্থ।
২. বংশ ও জন্ম পরিচয় : গৌতম বুদ্ধের পিতার নাম শুদ্ধোধন এবং মাতার নাম মায়াদেবী। বুদ্ধের অনেক নামের ` মধ্যে সিদ্ধার্থ ও গৌতম বহুল উচ্চারিত। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩, কারো কারো মতে ৫৬৭ অব্দের বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে মায়াদেবী পিত্রালয়ে গমনের পথে লুম্বিনী নিকুঞ্জে সিদ্ধার্থ ভূমিষ্ঠ হন। জন্মের সাতদিন পর তাঁর মা মারা যান। তাঁর বিমাতা মতান্তরে মাসি মহাপ্রজাপতি তাকে লালনপালন করেন।
৩. স্বভাবের বৈরাগ্য : গৌতম বুদ্ধ রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাজকীয় প্রাচুর্যের মধ্যে লালিতপালিত হলেও তাঁর মধ্যে সবসময় এক ধরনের বৈরাগ্যভাব ও চিন্তাশীলতা লক্ষ্য করা যায়।
৪. বৈবাহিক অবস্থা : বাল্যকাল হতেই গৌতম বুদ্ধের বৈরাগ্য ভাব লক্ষ্য করে তাঁর পিতা তাঁকে সংসারমুখী করার প্রত্যাশায় মাত্র ষোলো বছর বয়সে প্রতিবেশী কোলীয় বংশীয় সুন্দরী রাজকুমারী যশোধরার সঙ্গে (ভদ্রা কপিলায়নী) গৌতমের বিয়ে দেন। বিবাহের তের বছর পর তার পুত্র রাহুলের জন্ম হয়।
৫. সন্ন্যাস গ্রহণ : রাজ সুখৈশ্বর্য এবং সুন্দরী স্ত্রীর আকর্ষণও গৌতম বুদ্ধকে বেশিদিন সংসারে বেঁধে রাখতে পারে নি। মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে তিনি স্ত্রী, সদ্যোজাত শিশুপুত্র এবং রাজ সিংহাসনের মায়া পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসী জীবন গ্রহণ করে সংসার ত্যাগ করেন।
৬. সত্য উপলব্ধি : সংসারে রোগ, জরা, মৃত্যুর দৃশ্য দেখে তিনি বেদনায় কাতর হয়ে পড়েন। অবশেষে তাঁর সম্পর্কে গণকের পূর্বকথন অনুসারে একদা কপিলাবস্তুর রাজপথে একে একে জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুর দৃষ্টান্ত এবং এক সন্ন্যাসীর দর্শন পেলেন এবং উপলব্ধি করলেন যে এ জগৎ দুঃখে পরিপূর্ণ।
৭. ধ্যানরত অবস্থা : সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৌতম বুদ্ধ পদব্রজে প্রথমে রাজগীর এবং সেখান থেকে উর বিল্লতে গমন করেন। নিরঞ্জনা নদীর তীরে রমনীয় বালুতট উরবেলায় বিশাল এক অশ্বত্থ বৃক্ষতলে তিনি ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়েন।
৮. বোধি লাভ : ধ্যানমগ্ন হয়ে বুদ্ধ সত্যের জ্ঞান অর্জনের জন্য সাধনা করতে থাকেন। দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনা শেষে তিনি ৩৫ বছর বয়সে বোধি বা সত্যের জ্ঞান লাভ করেন। বোধি লাভ করে তিনি সম্যক জ্ঞানী হলেন বা সত্যের স্বরূপ সম্পর্কে অবগত হন।
৯. বাণী ও ধর্ম প্রচার : গৌতম বুদ্ধ ৪৫ বছর যাবৎ বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করে তার সত্য উপলব্ধিকৃত বাণী, ধর্ম প্রচার ও মানবতার সেবা করেন। কালক্রমে তাঁর বাণী চতুর্দিকে দেশ-দেশান্তরে, দক্ষিণে সিংহল, ব্রহ্মদেশ ও শ্যাম, উত্তরে তিব্বত, চীন, জাপান ও কোরিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
তাঁর এ বাণীই বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন নামে পরিচিত।
১০. গণশিক্ষার প্রসার : গৌতম বুদ্ধ যে কেবল মানুষের চিরকালের দুঃখ-দুর্দশা, জরা; মৃত্যু প্রভৃতি সম্পর্কে ভাবতেন তা নয়। তিনি কাল এবং সমাজ সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। কোশল-মগধের ভাষা অর্থাৎ মাগধী প্রাকৃত ও পালি ভাষায় ধর্মালোচনা করে তিনি গণশিক্ষার প্রসার ঘটান।
১১. বৌদ্ধ সংঘ প্রতিষ্ঠা : বৌদ্ধদের আশ্রয়ের জন্য তিনি সংঘ নির্মাণ করেন। ব্রাহ্মণ প্রভাবিত সমাজে প্রগতিবাদী বৌদ্ধদের আশ্রয়ের অভাব হবে বুঝতে পেরে তিনি অসংখ্য সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন।
১২. জাতিভেদ দূর : গৌতম বুদ্ধ প্রতিষ্ঠিত এসব সংঘে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করতে পারত। আশ্রয়হীন সকল মানুসেষর শেষ গন্তব্য ছিল এসব সংঘ। বুদ্ধ তার বৌদ্ধসংঘে সকল জাতিভেদ এবং বর্ণ বৈষম্য প্রথা তুলে দেন।
১৩. বেদের প্রাধান্য অস্বীকার : গৌতম বুদ্ধ ছিলেন জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীরের সমসাময়িক। তিনি বেদে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর দর্শন ভারতীয় দর্শনে নাস্তিক্যবাদী দর্শন নামে খ্যাত, কারণ তাঁর দর্শন বেদের প্রাধান্য স্বীকার করে না এবং বেদের অনুশাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।
১৪. পরাতত্ত্বে অনাগ্রহ : গৌতম বুদ্ধ পরাতাত্ত্বিক বিষয়ে কৌতুহল প্রদর্শন করতেন না। তার সামনে যে কোন ধরনের পরাতাত্ত্বিক প্রশ্ন উত্থাপিত হলে তিনি কৌশলে তা এড়িয়ে যেতেন। তিনি সব ধরনের পরাতাত্ত্বিক আলোচনা এড়িয়ে চলতেন।
১৫. কথোপকথনের মাধ্যমে শিক্ষাদান : বুদ্ধত্বলাভের পর বুদ্ধদেব তাঁর ধ্যানলব্ধ জ্ঞান চারিদিকে প্রচার করতে মনস্থ করেন এবং প্রাচীন ভারতের ধর্মগুরুদের ন্যায় কথোপকথনের মাধ্যমে দুঃখ-জর্জরিত জনগণকে তাঁর উপদেশাবলি শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন। বুদ্ধদেবের এই শিক্ষাদান বহু বৎসর মুখে মুখে প্রচলিত ছিল।
১৬. চারটি আর্যসত্যের জ্ঞান : ধ্যানমগ্ন অবস্থায় এবং গভীর চিন্তার কঠোর সাধনার ফলে বুদ্ধদেব চারটি সত্যের জ্ঞান লাভ করেন। এগুলোকে আর্যসত্য বলা হয়। এ চারটি আর্যসত্য হলো- (i) দুঃখ আছে, (ii) দুঃখের কারণ আছে, (iii) দুঃখের নিবৃত্তি আছে এবং (iv) দুঃখ নিবৃত্তির মার্গ বা পথও আছে।
১৭. দার্শনিক সমস্যার সমাধান : গৌতম বুদ্ধের মতে, দার্শনিক সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান কোন মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। তাছাড়া এসব সমস্যার সমাধান করতে গেলে নানা মতভেদের সৃষ্টি হয়। সুতরাং তাঁর মতে, দার্শনিক সমস্যার সমাধানের চেষ্টা অনাবশ্যক ও নিষ্ফল এবং এতে অযথা সময় নষ্ট হয়, কেননা এ থেকে আমরা কোন ফল পাই না।
১৮. বুদ্ধের জীবনের লক্ষ্য : গৌতম বুদ্ধের জীবনের চরম লক্ষ্য ও ব্রত ছিল দুঃখদুর্দশা হতে মানুষের পরিত্রাণের পথ উদ্ঘাটন করা এবং জনগণকে ঐ পথের নির্দেশ দেওয়া। তিনি বাস্তব দৃষ্টি নিয়ে জগৎকে দেখেছেন। বুদ্ধদেব বলতেন, দুঃখ হতে মুক্তি বা নির্বাণ লাভই মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য।
১৯. ইহধাম ত্যাগ : বোধি লাভের পর গৌতম বুদ্ধ দীর্ঘ ৪৫ বছর যাবৎ ৪টি আর্যসত্য ও ৮টি মার্গ দুঃখপীড়িত জনগণের মাঝে প্রচার করেছেন। জটিল তত্ত্বালোচনা পরিত্যাগ করে নীতি ও ধর্মের প্রচার ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। বহু বছর ধরে অহিংসা, প্রেম ও করুণার বাণী প্রচার করে অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দে ৮০ বছর বয়সে, বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে, কুশী
নগরে গৌতম বুদ্ধ ইহধাম ত্যাগ করেন।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, রাজকীয় ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিতপালিত হয়েও গৌতম বুদ্ধ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দ্বারা যেভাবে পীড়িত হয়েছেন তা সত্যিই অবিস্মরণীয়। তিনি সন্ন্যাসজীবনের প্রথমে বহু সাধুজনের শরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্তু কারও কাছ থেকে দুঃখের রহস্যের কোন সমাধান পান নি। অবশেষে তিনি তাঁর আত্মশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে সত্যের জ্ঞান লাভ করেন। সত্যের জ্ঞান
লাভের পর তিনি তার অহিংসা, প্রেম ও করুণার বাণী বহু বছর ধরে মানুষের মাঝে প্রচার করেন। গৌতম বুদ্ধ কেবল মানুষের চিরকালের দুঃখদুর্দশা, জরা, কষ্ট ইত্যাদি নিয়েই যৈ কেবল ভাবতেন তা নয়। তিনি সমাজের সকল বিষয় সম্পর্কেই সচেতন ছিলেন।