একে তো বরের হাট মহার্ঘ তাহার পরে ধনুক ভাঙ্গা পণ
অপরিচিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
লেখক-পরিচিতি:
বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৭মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ বাবা-মা’র চতুর্দশ সন্তান ও অষ্টম পুত্র। তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা সারদা দেবী। বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার জন্য পাঠানো হলেও বিদ্যালয়ের পড়ালেখার প্রতি তিনি মনোযোগী ছিলেন না। ঠাকুর বাড়ির অনুকূল পরিবেশে শৈশবেই রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। ১৮৭৬ সালে পনের বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ বনফুল। অতঃপর কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, ভ্রমণসাহিত্য, রম্যরচনা, সঙ্গীত ইত্যাদি শাখায় রবীন্দ্রনাথ রেখে গেছেন তাঁর অসামান্য শিল্প প্রতিভার স্বাক্ষর। তার হাতেই সম্পন্ন হয় বাংলা ছোটগল্পের ভিত্তি ও প্রতিষ্ঠা। মাত্র ষোল বছর বয়সে ‘ভিখারিনী’ গল্প রচনার মধ্য দিয়ে ছোটগল্প-লেখক হিসেবে তাঁর আবির্ভাব। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন গ্রন্থে মোট ১১৯টি ছোটগল্প লিখেছেন। তাঁর সর্বশেষ গল্পটির নাম ‘মুসলমানির গল্প’।গল্পরচনায় বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও বিশেষ করে শিলাইদহ তাঁকে বিশেষভাবে
প্রভাবিত করেছিল। এজন্য তাঁর গল্পে প্রকৃতি একটি বিশেষ চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গীতিময়তা তাঁর গল্পের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কেবল সাহিত্যিক হিসেবেই নয়, একজন কর্মযোগী মানুষ হিসেবেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনন্য কীর্তির পরিচয় রেখে গেছেন। ১৯০১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়’। এটিই পরবর্তীকালে
‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপলাভ করে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলি(১৯১১) কাব্যের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে প্রথম কৃষিব্যাংক স্থাপন করেন। বাংলাদেশের শিলাইদহ, পতিসর এবং শাহজাদপুরে জমিদারি তত্ত্বাবধান সূত্রে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় অতিবাহিত করেন। গীতিকার ও চিত্রশিল্পী হিসেবেও রবীন্দ্রনাথের অবদান অনন্য সাধারণ। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ) কলকাতায় তিনি পরলোকগমন করেন।তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা : কাব্যগ্রন্থ : মানসী (১৮৯০), সোনার তরী (১৮৯৪), চিত্রা (১৮৯৬),ক্ষণিকা (১৯০০), গীতাঞ্জলি (১৯১১) বলাকা (১৯১৬),পুনশ্চ (১৯৩২), জন্মদিনে (১৯৪১),শেষলেখা (১৯৪১); উপন্যাস : চোখের বালি (১৯০৩), গোরা (১৯১০),ঘরে-বাইরে (১৯১৬),শেষের কবিতা (১৯২৯); ছোটগল্প : গল্পগুচ্ছ (১ম ও ২য় খণ্ড-১৯২৬, ৩য় খণ্ড-১৯২৭), তিনসঙ্গী (১৯৪১), গল্পসল্প (১৯৪১); নাটক : বিসর্জন (১৮৯০),চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২),অচলায়তন (১৯১২), ডাকঘর (১৯১২), রক্তকরবী (১৯২৬); প্রবন্ধ : আধুনিক সাহিত্য (১৯০৭), কালান্তর (১৯৩৭), সাহিত্যের স্বরূপ (১৯৪৩); আত্মজীবনী : জীবন স্মৃতি (১৯১২), ছেলেবেলা (১৯৪০)।
ভূমিকা: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ছোটগল্প ‘অপরিচিতা’ প্রথম প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার ১৩২১ বঙ্গাব্দের (১৯১৪) কার্তিক সংখ্যায়। এটি তৎকালীন উচ্চ সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতা-বিষয়ক একটি গল্প।গল্পটি প্রথম গ্রন্থভুক্ত হয় রবীন্দ্র গল্পের সংকলন ‘গল্পসপ্তক’-এ এবং পরে ‘গল্পগুচ্ছ’ তৃতীয় খণ্ডে (১৯২৭)। যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে এটি একটি প্রতিবাদী গল্প। অন্যদিকে, গল্পকারএখানেনারীর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বকে তাঁর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায়
ব্যাখ্যা করেছেন।
মূলপাঠ: আজ আমার বয়স সাতাশ মাত্র। এ জীবনটা না দৈর্ঘ্যরে হিসাবে বড়, না গুণের হিসাবে। তবু ইহার একটু বিশেষ মূল্য আছে। ইহা সেই ফুলের মতো যাহার বুকের উপরে ভ্রমর আসিয়া বসিয়াছিল, এবং সেই পদক্ষেপের ইতিহাস তাহার জীবনের মাঝখানে ফলের মতো গুটি ধরিয়া উঠিয়াছে।
সেই ইতিহাসটুকু আকারে ছোটো, তাহাকে ছোটো করিয়াই লিখিব। ছোটোকে যাঁহারা সামান্য বলিয়া ভুল করেন না তাঁহারা ইহার রস বুঝিবেন। কলেজে যতগুলো পরীক্ষা পাস করিবার সব আমি চুকাইয়াছি। ছেলেবেলায় আমার সুন্দর চেহারা লইয়া পণ্ডিতমশায় আমাকে শিমুল ফুল ও মাকাল ফলের সহিত তুলনা করিয়া, বিদ্রƒপ করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। ইহাতে তখন বড়ো লজ্জা পাইতাম; কিন্তু বয়স হইয়া এ কথা ভাবিয়াছি, যদি জন্মান্তর থাকে তবে আমার মুখে সুরূপ এবং পণ্ডিতমশায়দের মুখে বিদ্রƒপ আবার যেন অমনি করিয়াই প্রকাশ পায়। আমার পিতা এক কালে গরিব ছিলেন। ওকালতি করিয়া তিনি প্রচুর টাকা রোজগার করিয়াছেন, ভোগ করিবার সময় নিমেষমাত্রও পান নাই। মৃত্যুতে তিনি যে হাঁফ ছাড়িলেন সেই তাঁর প্রথম অবকাশ। আমার তখন বয়স অল্প। মার হাতেই আমি মানুষ। মা গরিবের ঘরের মেয়ে; তাই, আমরা যে ধনী এ কথা তিনিও ভোলেন না, আমাকে ভুলিতে দেন না। শিশুকালে আমি কোলে কোলেই মানুষÑ বোধ করি, সেইজন্য শেষ পর্যন্ত আমার পুরাপুরি বয়সই হইল না। আজও আমাকে দেখিলে মনে হইবে, আমি অন্নপূর্ণার কোলে গজাননের ছোটো ভাইটি। আমার আসল অভিভাবক আমার মামা। তিনি আমার চেয়ে বড়োজোর বছর ছয়েক বড়। কিন্তু ফল্গুর বালির মতো তিনি আমাদের সমস্ত সংসারটাকে নিজের অন্তরের মধ্যে শুষিয়া লইয়াছেন। তাঁহাকে না খুঁড়িয়া এখানকার এক গণ্ডূষও রস পাইবার জো নাই। এই কারণে কোনো-কিছুর জন্যই আমাকে কোনো ভাবনা ভাবিতেই হয় না। কন্যার পিতা মাত্রেই স্বীকার করিবেন, আমি সৎপাত্র। তামাকটুকু পর্যন্ত খাই না। ভালোমানুষ হওয়ার কোনো ঝঞ্ঝাট নাই, তাই আমি নিতান্ত ভালোমানুষ। মাতার আদেশ মানিয়া চলিবার ক্ষমতা আমার আছেÑ বস্তুত, না মানিবার ক্ষমতা আমার নাই। অন্তঃপুরের শাসনে চলিবার মতো করিয়াই আমি প্রস্তুত হইয়াছি, যদি কোনো কন্যা স্বয়ম্বরা হন তবে এই সুলক্ষণটি স্মরণ রাখিবেন। অনেক বড়ো ঘর হইতে আমার সম্বন্ধ আসিয়াছিল। কিন্তু মামা, যিনি পৃথিবীতে আমার ভাগ্যদেবতার প্রধান এজেন্ট, বিবাহ সম্বন্ধে তাঁর একটা বিশেষ মত ছিল ধনীর কন্যা তাঁর পছন্দ নয়। আমাদের ঘরে যে মেয়ে আসিবে সে মাথা হেঁট করিয়া
আসিবে, এই তিনি চান। অথচ টাকার প্রতি আসক্তি তাঁর অস্থিমজ্জায় জড়িত। তিনি এমন বেহাই চান যাহার টাকা নাই অথচ যে টাকা দিতে কসুর করিবে না। যাহোক শোষণ করা চলিবে অথচ বাড়িতে আসিলে গুড়গুড়ির পরিবর্তে বাঁধা হুঁকায় তামাক দিলে যাহার নালিশ খাটিবে না। আমার বন্ধু হরিশ কানপুরে কাজ করে। সে ছুটিতে কলিকাতায় আসিয়া আমার মন উতলা করিয়া দিল। সে বলিল, “ওহে, মেয়ে যদি বল একটি খাসা মেয়ে আছে।” কিছুদিন পূর্বেই এমএ পাস করিয়াছি। সামনে যত দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে ছুটি ধূ ধূ করিতেছে; পরীক্ষা নাই, উমেদরি নাই, চাকরি নাই; নিজের বিষয় দেখিবার চিন্তাও নাই, শিক্ষাও নাই, ইচ্ছাও নাইÑ থাকিবার মধ্যেও ভিতরে আছেন মা এবং
বাহিরে আছেন মামা। এই অবকাশের মরুভূমির মধ্যে আমার হৃদয় তখন বিশ্বব্যাপী নারীরূপের মরীচিকা দেখিতেছিলÑ আকাশে তাহার দৃষ্টি,
বাতাসে তাহার নিঃশ্বাস, তরুমর্মরে তাহার গোপন কথা। এমন সময় হরিশ আসিয়া বলিল, “মেয়ে যদি বল, তবেÑ”। আমার শরীর-মন বসন্তবাতাসে বকুলবনের নবপল্লবরাশির
মতো কাঁপিতে কাঁপিতে আলোছায়া বুনিতে লগিল। হরিশ মানুষটা ছিল রসিক, রস দিয়া বর্ণনা করিবার শক্তি তাহার ছিল, আর আমার মন ছিল তৃষার্ত। আমি হরিশকে বলিলাম, “একবার মামার কাছে কথাটা পাড়িয়া দেখো।” হরিশ আসর জমাইতে অদ্বিতীয়। তাই সর্বত্রই তাহার খাতির। মামাও তাহাকে পাইলে ছাড়িতে চান না। কথাটা তাঁর
বৈঠকে উঠিল। মেয়ের চেয়ে মেয়ের বাপের খবরটাই তাঁহার কাছে গুরুতর। বাপের অবস্থা তিনি যেমনটি চান তেমনি। এক কালে ইহাদের বংশে লক্ষ্মীর মঙ্গলঘট ভরা ছিল। এখন তাহা শূন্য বলিলেই হয়, অথচ তলায় সামান্য কিছু বাকি আছে। দেশে বংশমর্যাদা রাখিয়া চলা সহজ নয় বলিয়া ইনি পশ্চিমে গিয়া বাস করিতেছেন। সেখানে গরিব গৃহস্থের মতোই থাকেন। একটি মেয়ে ছাড়া তাঁর আর নাই। সুতরাং তাহারই পশ্চাতে লক্ষ্মীর ঘটটি একেবারে উপুড় করিয়া দিতে দ্বিধা
হইবে না। এসব ভালো কথা। কিন্তু, মেয়ের বয়স যে পনেরো, তাই শুনিয়া মামার মন ভার হইল। বংশে তো কোনো দোষ নাই? না, দোষ নাইÑ বাপ কোথাও তাঁর মেয়ের যোগ্য বর খুঁজিয়া পান না। একে তো বরের হাট মহার্ঘ, তাহার পরে ধনুক-ভাঙা পণ, কাজেই বাপ কেবলই সবুর করিতেছেনÑ কিন্তু মেয়ের বয়স সবুর করিতেছে না।
যাই হোক, হরিশের সরস রসনার গুণ আছে। মামার মন নরম হইল। বিবাহের ভূমিকা-অংশটা নির্বিঘ্নে সমাধা হইয়া গেল। কলিকাতার বাহিরে বাকি যে পৃথিবীটা আছে সমস্তটাকেই মামা আন্ডামান দ্বীপের অন্তর্গত বলিয়া জানেন। জীবনে একবার বিশেষ কাজে তিনি কোন্নগর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মামা যদি মনু হইতেন তবে তিনি হাবড়ার পুল পার হওয়াটাকে তাঁহার সংহিতায় একেবারে নিষেধ করিয়া দিতেন। মনের মধ্যে ইচ্ছা ছিল, নিজের চোখে মেয়ে দেখিয়া আসিব। সাহস করিয়া
প্রস্তাব করিতে পারিলাম না। কন্যাকে আশীর্বাদ করিবার জন্য যাহাকে পাঠানো হইল সে আমাদের বিনুদাদা, আমার পিস্ততো ভাই। তাহার মতো রুচি
এবং দক্ষতার ’পরে আমি ষোলো-আনা নির্ভর করিতে পারি। বিনুদা ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “মন্দ নয় হে! খাঁটি সোনা
বটে!” বিনুদাদার ভাষাটা অত্যন্ত আঁট। যেখানে আমরা বলি ‘চমৎকার’ সেখানে তিনি বলেন ‘চলনসই’। অতএব বুঝিলাম, আমার
ভাগ্যে প্রজাপতির সঙ্গে পঞ্চশরের কোনো বিরোধ নাই।
বলা বাহুল্য, বিবাহ-উপলক্ষে কন্যাপক্ষকেই কলিকাতায় আসিতে হইল। কন্যার পিতা শম্ভুনাথবাবু হরিশকে কত বিশ্বাস করেন তাহার প্রমাণ এই যে, বিবাহের তিন দিন পূর্বে তিনি আমাকে প্রথম চক্ষে দেখেন এবং আশীর্বাদ করিয়া যান। বয়স তাঁর চল্লিশের কিছু এপারে বা ওপারে। চুল কাঁচা, গোঁফে পাক ধরিতে আরম্ভ করিয়াছে মাত্র। সুপুরষ বটে। ভিড়ের মধ্যে দেখিলে সকলের আগে তাঁর উপরে চোখ পড়িবার মতো চেহারা।
আশা করি আমাকে দেখিয়া তিনি খুশি হইয়াছিলেন। বোঝা শক্ত, কেননা তিনি বড়ই চুপচাপ। যে দুটি-একটি কথা বলেন যেন তাহাতে পুরা জোর দিয়া বলেন না। মামার মুখ তখন অনর্গল ছুটিতেছিলÑ ধনে মানে আমাদের স্থান যে শহরের কারও চেয়ে কম নয়, সেইটেকেই তিনি নানা প্রসঙ্গে প্রচার করিতেছিলেন। শম্ভুনাথবাবু এ কথায় একেবারে যোগই দিলেন নাÑ কোনো ফাঁকে একটা হুঁ বা হ্যাঁ কিছুই শোনা গেল না। আমি হইলে দমিয়া যাইতাম, কিন্তু মামাকে দমানো শক্ত। তিনি শম্ভুনাথবাবুর চুপচাপ ভাব দেখিয়া ভাবিলেন, লোকটা নিতান্ত নির্জীব, একেবারে কোনো তেজ নাই। বেহাই-সম্প্রদায়ের আর যাই থাক, তেজ থাকাটা দোষের, অতএব মামা মনে মনে খুশি হইলেন। শম্ভুনাথবাবু যখন উঠিলেন তখন মামা সংক্ষেপে উপর হইতেই তাঁকে বিদায় করিলেন, গাড়িতে তুলিয়া দিতে গেলেন না। পণ সম্বন্ধে দুই পক্ষে পাকাপাকি কথা ঠিক হইয়া গিয়াছিল। মামা নিজেকে অসামান্য চতুর বলিয়াই অভিমান করিয়া থাকেন। কথাবার্তায় কোথাও তিনি কিছু ফাঁক রাখেন নাই। টাকার অঙ্ক তো স্থির ছিলই, তারপরে গহনা কত ভরির এবং
সোনা কত দরের হইবে সেও একেবারে বাঁধাবাঁধি হইয়া গিয়াছিল। আমি নিজে এসমস্ত কথার মধ্যে ছিলাম না; জানিতাম না দেনা-পাওনা কী স্থির হইল। মনে জানিতাম, এই স্থূল অংশটাও বিবাহের একটা প্রধান অংশ, এবং সে অংশের ভার যার উপরে তিনি এক কড়াও ঠকিবেন না। বস্তুত, আশ্চর্য পাকা লোক বলিয়া মামা আমাদের সমস্ত সংসারের প্রধান গর্বের সামগ্রী। যেখানে আমাদের কোনো সম্বন্ধ আছে সেখানে সর্বত্রই তিনি বুদ্ধির লড়াইয়ে জিতিবেন, এ একেবারে ধরা কথা, এই জন্য আমাদের অভাব না থাকিলেও এবং অন্য পক্ষের অভাব কঠিন হইলেও জিতিব, আমাদের সংসারের এই জেদ ইহাতে যে বাঁচুক আর যে মরুক। গায়ে-হলুদ অসম্ভব রকম ধুম করিয়া গেল। বাহক এত গেল যে তাহার আদমশুমারি করিতে হইলে কেরানি রাখিতে হয়। তাহাদিগকে বিদায় করিতে অপর পক্ষকে যে নাকাল হইতে হইবে, সেই কথা স্মরণ করিয়া মামার সঙ্গে মা একযোগে বিস্তর হাসিলেন। ব্যান্ড, বাঁশি, শখের কন্সর্ট প্রভৃতি যেখানে যতপ্রকার উচ্চ শব্দ আছে সমস্ত একসঙ্গে মিশাইয়া বর্বর কোলাহলের মত্ত হস্তী
দ্বারা সংগীত সরস্বতীর পদ্মবন দলিত বিদলিত করিয়া আমি তো বিবাহ-বাড়িতে গিয়া উঠিলাম। আংটিতে হারেতে জরিজহরাতে আমার শরীর যেন গহনার দোকান নিলামে চড়িয়াছে বলিয়া বোধ হইল। তাঁহাদের ভাবী জামাইয়ের মূল্য কত সেটা যেন কতক পরিমাণে সর্বাঙ্গে স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া ভাবী শ্বশুরের সঙ্গে মোকাবিলা করিতে চলিয়াছিলাম।
মামা বিবাহ-বাড়িতে ঢুকিয়া খুশি হইলেন না। একে তো উঠানটাতে বরযাত্রীদের জায়গা সংকুলান হওয়াই শক্ত, তাহার পরে সমস্ত আয়োজন নিতান্ত মধ্যম রকমের। ইহার পরে শম্ভুনাথবাবুর ব্যবহারটাও নেহাত ঠান্ডা। তাঁর বিনয়টা অজস্র নয়। মুখে তো কথাই নাই কোমরে চাদর বাঁধা, গলা ভাঙা, টাক-পড়া, মিশ-কালো এবং বিপুল-শরীর তাঁর একটি উকিল-বন্ধু যদি নিয়ত হাত জোড় করিয়া মাথা হেলাইয়া, নম্রতার স্মিতহাস্যে ও গদগদ বচনে কন্সর্ট পার্টির করতাল-বাজিয়ে হইতে শুরু করিয়া বরকর্তাদের প্রত্যেককে বার বার প্রচুররূপে অভিষিক্ত করিয়া না দিতেন তবে গোড়াতেই এটা এস্পার-ওস্পার হইত। আমি সভায় বসিবার কিছুক্ষণ পরেই মামা শম্ভুনাথবাবুকে পাশের ঘরে ডাকিয়া লইয়া গেলেন। কী কথা হইল জানি না, কিছুক্ষণ পরেই শম্ভুনাথবাবু আমাকে আসিয়া বলিলেন, “বাবাজি, একবার এই দিকে আসতে হচ্ছে।” ব্যাপারখানা এই। Ñসকলের না হউক, কিন্তু কোনো কোনো মানুষের জীবনের একটা কিছু লক্ষ্য থাকে। মামার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তিনি কোনোমতেই কারও কাছে ঠকিবেন না। তাঁর ভয় তাঁর বেহাই তাঁকে গহনায় ফাঁকি দিতে পারেন বিবাহকার্য শেষ হইয়া গেলে সে ফাঁকির আর প্রতিকার চলিবে না। বাড়িভাড়া সওগাদ লোক-বিদায় প্রভৃতি সম্বন্ধে যেরকম টানাটানির পরিচয় পাওয়া গেছে তাহাতে মামা ঠিক করিয়াছিলেনÑ দেওয়া-থোওয়া সম্বন্ধে এ লোকটির শুধু মুখের কথার উপর ভর করা চলিবে না। সেইজন্য বাড়ির স্যাকরাকে সুদ্ধ সঙ্গে আনিয়াছিলেন। পাশের ঘরে গিয়া দেখিলাম, মামা এক তক্তপোশে এবং স্যাক্রা তাহার দাঁড়িপাল্লা কষ্টিপাথর প্রভৃতি লইয়া মেজেয় বসিয়া আছে।
শম্ভুনাথবাবু আমাকে বলিলেন, “তোমার মামা বলিতেছেন বিবাহের কাজ শুরু হইবার আগেই তিনি কনের সমস্ত গহনা যাচাই করিয়া দেখিবেন, ইহাতে তুমি কী বল।” আমি মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া রহিলাম। ঐঝঈ-১৮৫১ গদ্যÑ১৯ মামা বলিলেন, “ও আবার কী বলিবে।
যা বলিব তাই হইবে।” শম্ভুনাথবাবু আমার দিকে চাহিয়া কহিলেন, “সেই কথা তবে ঠিক? উনি যা বলিবেন তাই হইবে? এ সম্বন্ধে তোমার কিছুই
বলিবার নাই?” আমি একটু ঘাড়-নাড়ার ইঙ্গিতে জানাইলাম, এসব কথায় আমার সম্পূর্ণ অনধিকার। “আচ্ছা তবে বোসো, মেয়ের গা হইতে সমস্ত গহনা খুলিয়া আনিতেছি।” এই বলিয়া তিনি উঠিলেন। মামা বলিলেন, “অনুপম এখানে কী করিবে। ও সভায় গিয়া বসুক।” শম্ভুনাথ বলিলেন, “না, সভায় নয়, এখানেই বসিতে হইবে।” কিছুক্ষণ পরে তিনি একখানা গামছায় বাঁধা গহনা আনিয়া তক্তপোশের উপর মেলিয়া ধরিলেন। সমস্তই তাঁহার পিতামহীদের আমলের গহনাÑ হাল ফ্যাশনের সূক্ষ্ম কাজ নয়Ñ যেমন মোটা তেমনি ভারী। স্যাকরা গহনা হাতে তুলিয়া লইয়া বলিল, “এ আর দেখিব কী। ইহাতে খাদ নাইÑ এমন সোনা এখনকার দিনে ব্যবহার হয় না।” এই বলিয়া সে মকরমুখা মোটা একখানা বালায় একটু চাপ দিয়া দেখাইল তাহা বাঁকিয়া যায়। মামা তখনই নোটবইয়ে গহনাগুলির ফর্দ টুকিয়া লইলেন, পাছে যাহা দেখানো হইল তাহার কোনোটা কম পড়ে। হিসাব করিয়া দেখিলেন, গহনা যে পরিমাণ দিবার কথা এগুলি সংখ্যায় দরে এবং ভারে তার অনেক বেশি। গহনাগুলির মধ্যে একজোড়া এয়ারিং ছিল। শম্ভুনাথ সেইটে স্যাকরার হাতে দিয়া বলিলেন, “এইটে একবার পরখ করিয়া দেখো।” স্যাকরা কহিল, “ইহা বিলাতি মাল, ইহাতে সোনার ভাগ সামান্যই আছে।” শম্ভুবাবু এয়ারিং জোড়া মামার হাতে দিয়া বলিলেন, “এটা আপনারাই রাখিয়া দিন।” মামা সেটা হাতে লইয়া দেখিলেন, এই এয়ারিং দিয়াই কন্যাকে তাঁহারা আশীর্বাদ করিয়াছিলেন। মামার মুখ লাল হইয়া উঠিল। দরিদ্র তাঁহাকে ঠকাইতে চাহিবে কিন্তু তিনি ঠকিবেন না এই আনন্দ-সম্ভোগ হইতে বঞ্চিত হইলেন এবং তাহার উপরেও কিছু উপরি-পাওনা জুটিল। অত্যন্ত মুখ ভার করিয়া বলিলেন, “অনুপম, যাও, তুমি সভায় গিয়ে বোসো গে।” শম্ভুনাথবাবু বলিলেন, “না, এখন সভায় বসিতে হইবে না। চলুন, আগে আপনাদের খাওয়াইয়া দিই।” মামা বলিলেন, “সে কী কথা। লগ্নÑ” শম্ভুনাথবাবু বলিলেন, “সেজন্য কিছু ভাবিবেন নাÑ এখন উঠুন।” লোকটি নেহাত ভালোমানুষ-ধরনের, কিন্তু ভিতরে বেশ একটু জোর আছে বলিয়া বোধ হইল। মামাকে উঠিতে হইল। বরযাত্রীদেরও আহার হইয়া গেল। আয়োজনের আড়ম্বর ছিল না। কিন্তু রান্না ভালো এবং সমস্ত বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন
বলিয়া সকলেরই তৃপ্তি হইল। বরযাত্রীদের খাওয়া শেষ হইলে শম্ভুনাথবাবু আমাকে খাইতে বলিলেন। মামা বলিলেন, “সে কী কথা। বিবাহের পূর্বে বর খাইবে কেমন করিয়া।” এ সম্বন্ধে মামার কোনো মতপ্রকাশকে তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তুমি কী বল। বসিয়া যাইতে দোষ কিছু আছে?” মূর্তিমতী মাতৃ-আজ্ঞা-স্বরূপে মামা উপস্থিত, তাঁর বিরুদ্ধে চলা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি আহারে বসিতে পারিলাম না। তখন শম্ভুনাথবাবু মামাকে বলিলেন, “আপনাদিগকে অনেক কষ্ট দিয়াছি। আমরা ধনী নই, আপনাদের যোগ্য আয়োজন করিতে পারি নাই, ক্ষমা করিবেন। রাত হইয়া গেছে, আর আপনাদের কষ্ট বাড়াইতে ইচ্ছা করি না। এখন তবেÑ” মামা বলিলেন, “তা, সভায় চলুন, আমরা তো প্রস্তুত আছি।”
শম্ভুনাথ বলিলেন, “তবে আপনাদের গাড়ি বলিয়া দিই?” মামা আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “ঠাট্টা করিতেছেন নাকি।” শম্ভুনাথ কহিলেন, “ঠাট্টা তো আপনিই করিয়া সারিয়াছেন। ঠাট্টার সম্পর্কটাকে স্থায়ী করিবার ইচ্ছা আমার নাই।” মামা দুই চোখ এত বড়ো করিয়া মেলিয়া অবাক হইয়া রহিলেন। শম্ভুনাথ কহিলেন, “আমার কন্যার গহনা আমি চুরি করিব এ কথা যারা মনে করে তাদের হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না।” আমাকে একটি কথা বলাও তিনি আবশ্যক বোধ করিলেন না। কারণ, প্রমাণ হইয়া গেছে, আমি কেহই নই। তারপরে যা হইল সে আমি বলিতে ইচ্ছা করি না। ঝাড়লণ্ঠন ভাঙিয়া-চুরিয়া, জিনিসপত্র লন্ডভন্ড করিয়া, বরযাত্রের দল দক্ষযজ্ঞের পালা সারিয়া বাহির হইয়া গেল। বাড়ি ফিরিবার সময় ব্যান্ড রসনচৌকি ও কন্সর্ট একসঙ্গে বাজিল না এবং অভ্রের ঝাড়
উপসংহার: যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের গল্প ‘অপরিচিতা’Ñ ব্যক্তিত্বহীন এক যুবক অনুপমের জবানিতে লেখা। গল্পে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী কল্যাণী ও তার পিতা শম্ভুনাথ সেনের চারিত্রিক দৃঢ়তার ফলেসমাজে গেড়ে বসা ঘৃণ্য যৌতুক প্রথা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। অনুপমের বয়স যখন অল্প, তার বাবা ওকালতি করে প্রচুর বিত্তের অধিকারী হয়েও ভোগ করার আগেই মারা যান। পিতৃহারা পুত্রকে তার মা এতটুকু কষ্ট করতে দেননি, ফলে সাধারণ ঘরের ছেলেদের মতো অনুপমের মানসিক বয়োবৃদ্ধি ঘটেনি। তার মামাই এখন অভিভাবক হয়ে সমস্ত সংসারটিকে কুক্ষিগত করেছেন। আর্থিক অবস্থা ভালো না হলেও শম্ভুনাথ বাবুর একমাত্র মেয়ে কল্যাণীর সঙ্গে অনুপমের বিয়ের প্রস্তাব এলে তার মামা রাজী হয়ে যান। বিয়ের দিন মামা আকস্মিকভাবেই কন্যাপক্ষের দেওয়া সমস্ত গহনা যাচাই করতে চাইলে শম্ভুনাথ বাবু বিস্মিত ও মনঃক্ষুণ্ন হন। তিনি কল্যাণীকে আর অনুপমের হাতে সমর্পণ না করেই অতিথিদের যথারীতি আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিলেন। বিয়েটা এভাবেই ভেঙে গেল। যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের গল্প ‘অপরিচিতা’Ñ ব্যক্তিত্বহীন এক যুবক অনুপমের জবানিতে লেখা। গল্পে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী কল্যাণী ও তার পিতা শম্ভুনাথ সেনের চারিত্রিক দৃঢ়তার ফলেসমাজে গেড়ে বসা ঘৃণ্য যৌতুক প্রথা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। অনুপমের বয়স যখন অল্প, তার বাবা ওকালতি করে প্রচুর বিত্তের অধিকারী হয়েও ভোগ করার আগেই মারা যান। পিতৃহারা পুত্রকে তার মা এতটুকু কষ্ট করতে দেননি, ফলে সাধারণ ঘরের ছেলেদের মতো অনুপমের মানসিক বয়োবৃদ্ধি ঘটেনি। তার মামাই এখন অভিভাবক হয়ে সমস্ত সংসারটিকে কুক্ষিগত করেছেন। আর্থিক অবস্থা ভালো না হলেও শম্ভুনাথ বাবুর একমাত্র মেয়ে কল্যাণীর সঙ্গে অনুপমের বিয়ের প্রস্তাব এলে তার মামা রাজী হয়ে যান। বিয়ের দিন মামা আকস্মিকভাবেই কন্যাপক্ষের দেওয়া সমস্ত গহনা যাচাই করতে চাইলে শম্ভুনাথ বাবু বিস্মিত ও মনঃক্ষুণ্ন হন। তিনি কল্যাণীকে আর অনুপমের হাতে সমর্পণ না করেই অতিথিদের যথারীতি আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিলেন। বিয়েটা এভাবেই ভেঙে গেল।