উন্নয়নশীল দেশসমূহের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর।
অথবা, উন্নয়নশীল দেশসমূহের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমলাতন্ত্রের কার্যাবলি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, উন্নয়নশীল দেশসমূহের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমলাতন্ত্রের কী কী ভূমিকা রয়েছে?
উত্তর৷ ভূমিকা : আমলাতন্ত্র সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। পৃথিবীর উন্নত ও অনুন্নত সকল সমাজব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এটি আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফ্রান্সে সর্বপ্রথম আমলাতন্ত্রের ধারণাটির উৎপত্তি ঘটেছিল। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার সর্বপ্রথম আমলাতন্ত্রকে সুস্পষ্টভাবে একটি আনুষ্ঠানিক সংগঠনের রূপদান করেন। বস্তুত আমলাতন্ত্র একটি মৌলিক ধারণা এবং আধুনিক রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। প্রশাসনিক সত্যতা নির্মাণে ও জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।
উন্নয়নশীল দেশসমূহের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আগ্লাতন্ত্রের ভূমিকা (Role of bureaucracy in socioeconomic development of developing couries) : তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিম্নে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিক উন্নয়নে : আধুনিক সমাজব্যবস্থায় সামাজিক উন্নয়নে আমলাতন্ত্র একটি অনিবার্য প্রক্রিয়া। জনগণের দাবি পূরণের নিমিত্তে যে কোন প্রকার সরকারের পূর্বশর্ত হলো আমলাতন্ত্র। আর্থসামাজিক উন্নয়নে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের সফলতা ও ব্যর্থতার উপর একটি দেশের আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডের সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভরশীল। আর তাই একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অপরিসীম।
২. শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশে : তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহে শিল্পের বিকাশ আবশ্যক। আর এজন্য বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য আমলারা সরকারকে সাহায্য সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে থাকে। আর এতে করে শিল্প ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা জনগণ আমলাদের মাধ্যমে ভোগ করে থাকে।
৩. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে : তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন আবশ্যক। সেতু, কালভার্ট, রাস্তা ও ফ্লাইওভার নির্মাণের মাধ্যমে দেশের সামাজিক উন্নয়নে আমলাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৪. শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন : প্রত্যেকটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন আবশ্যক। শিক্ষা অর্জন ও তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ তার ভাগ্যের দ্রুত পরিবর্তন করতে পারে। আর আমলাদের সঠিক সহযোগিতার মাধ্যমেই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়। তাছাড়া আমলারা কোথায়, কিভাবে, কোন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করলে মানুষ শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে, সে অনুযায়ী সরকারকে নীতি প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করে।
৫. সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে : আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য সংস্কৃতির বিকাশ একান্ত অপরিহার্য। সংস্কৃতির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমলারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের জন্য চেষ্টা করেন। এদেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষদের সার্বিক জীবনচিত্র তুলে ধরে বিভিন্ন রকম আনন্দ আয়োজনের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া আমলারা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক
প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক উন্নতি সাধনে ভূমিকা পালন করে থাকেন।
৬. সুনির্দিষ্ট কর্মপরিধি : আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিধি বিদ্যমান থাকে। এতে প্রতিটি কর্মচারী তার নিজ নিজ ক্ষেত্রে কার্যসম্পাদন করে। আইনের মাধ্যক্রম এ কর্মপরিধি নির্ধারিত হয়।
৭. রাজনৈতিক অংশগ্রহণ : রাজনৈতিক অংশগ্রহণ রাজনৈতিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নাগরিকদের রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণ, আনুগত্য ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়াকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলে। তাই নাগরিকদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি গুণাবলির বিকাশ সাধন করে তাদেরকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য ।
৮. রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ : রাজনৈতিক উন্নয়ন যেসব পূর্বশর্তের উপর নির্ভর করে আমলাতন্ত্র তাদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, প্রশাসন পরিচালনা, জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি গঠন প্রভৃতি বিষয়
ে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৯. আইন ও নীতি বাস্তবায়নে: আমলাগণ কেবল আইন ও নীতিসমূহ প্রণয়নই করেন না, তারা এগুলো বাস্তবায়নও করে থাকেন। সরকারি আইন ও নীতিসমূহ যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় সেদিকে তারা লক্ষ্য রাখেন।
১০. সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় : সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। এছাড়া রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমেও সরকারি নীতি ও কর্মসূচির সাথে জনগণকে অবহিত করে এবং তাদেরকে ঐ কর্মসূচির উপযোগী করে গড়ে তুলতে নানাভাবে সহযোগিতা করে থাকে।
১১. আমলাতন্ত্র ও নিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে : যেহেতু আমলাতন্ত্র একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান সুতরাং আমলাতন্ত্র দলমত, শ্রেণি ও যাবতীয় সংকীর্ণ মোহের ঊর্ধ্বে থেকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে চলে। এ ধরনের কর্তব্য পালনের সময় আমলাগণ কোন বিশেষ শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য না করে সর্বজনীন স্বার্থের কথা চিন্তা করেন এবং এভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সাম্য, নিরপেক্ষতা, উদারতা প্রভৃতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আমলাতন্ত্র তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া এটি উন্নয়নশীল দেশসমূহের রাষ্ট্রীয় কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম। বস্তুত আমলাতন্ত্রের দক্ষতা ও প্রযুক্তিবিদ্যাভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। তাই আমলাতন্ত্রের ভূমিকাকে কখনো প্রত্যাখ্যান করা যায় না।