General Knowledge

ইতিহাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, ইতিহাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ইতিহাস মানবগোষ্ঠীর অতীত কার্যাবলির দর্পণস্বরূপ। ইতিহাস বলতে আজ আর কেবল রাজা, মহারাজা বা বাদশাহের কাহিনি বা তাদের শাসনব্যবস্থাকে বুঝায় না, বরং সমগ্র মানবজাতির সভ্যতার পথে অগ্রগতির কাহিনিকে বুঝায়। “History is a movement in time.” অর্থাৎ, সময়সীমার মধ্যে ইতিহাস একটি আন্দোলন, যার গতি আছে, যা অতীত থেকে শুরু করে বর্তমান সময় সীমার ভিতর দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলে এবং একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার স্বপ্ন জাগায়।
ইতিহাসের বিষয়বস্তু : ইতিহাস মানবসমাজের অতীত কার্যাবলির বিবরণ। তবে ইতিহাস শুধু অতীত নিয়েই আলোচনা করে না; অতীতের দোষগুণ পর্যালোচনা করে বর্তমানের ভুলত্রুটি সংশোধন করে সঠিক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলে। তাই ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় ব্যাপক ও বিস্তৃত। অতীতের কোনো দিকই ইতিহাসের বিষয়বস্তুর বাইরে নয়। নিচে ইতিহাসের বিষয়বস্তুর বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হলো :
১. মানুষের উদ্ভব ও বিকাশ : ইতিহাসের প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মানুষের উদ্ভব ও বিকাশ পর্ব এবং মানুষের উৎপত্তি সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা। মানুষের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত আলোচনার মাধ্যমে মানুষের বর্তমান পর্যায় পর্যন্ত আসার বিবরণ দেওয়া ইতিহাসের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। ধর্মের ব্যাখ্যা থেকে বেরিয়ে ইতিহাসের মতে, মানুষের উৎপত্তি নীচু প্রাণী থেকে এবং ক্রমবিকাশের মাধ্যমে মানুষের উন্নীত হওয়া। মোটকথা, আদিম অবস্থা থেকে আধুনিক পর্যায় পর্যন্ত মানুষের ক্রমবিকাশ নিয়েই ইতিহাসের আলোচনা।
২. সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ : ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হচ্ছে সভ্যতার উত্থান ও বিস্তার। সৃষ্টির শুরুতে মানব সভ্যতায় মানুষের জীবনযাত্রা, বৃত্তি, পেশা, শিকার প্রভৃতি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের সব সভ্যতার ক্রমবিস্তার, পতন প্রভৃতি নিয়ে ইতিহাস আলোচনা করে। সভ্যতার কিভাবে উৎপত্তি ঘটেছে, এটা কোনো কোনো পর্যায়ে
বিস্তার লাভ করেছে, বিভিন্ন বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় কীভাবে বর্তমান পর্যায় উন্নীত হয়েছে এসব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু।
৩. প্রকৃতি ও পরিবেশ : প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়েও ইতিহাস আলোচনা করে। মানুষ কীভাবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে বর্তমান পর্যন্ত টিকে আছে। প্রকৃতির বিভিন্ন বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম করে মানুষ তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে তাই ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়।
৪. কাল বিভাজন : ইতিহাসের আরেকটি অন্যতম বিষয়বস্তু হচ্ছে কাল বিভাজন। কাল বিভাজন ছাড়া ইতিহাস রচনা করা অসম্ভব। ইতিহাস রচনা করতে হলে অবশ্যই কাল বিভাজনের প্রয়োজন এবং বিভিন্ন সময়ের সাথে বিভিন্ন সভ্যতার ইতিহাস রচিত হয়েছে। ইতিহাসের যুগ বিভাজনের তালিকায় প্রাগৈতিহাসিক যুগ, প্ৰটো ঐতিহাসিক যুগ, পুরাতন পাথরের যুগ, মধ্য পাথরের যুগ, নব্য পাথরের যুগ ও তাম্র প্রস্তর যুগ, প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ, উত্তর আধুনিক যুগ প্রভৃতি রয়েছে এবং ইতিহাস এসব যুগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে।
৫. প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন : পৃথিবীর সৃষ্টির শুরুতে মানুষ যখন বসবাস করতে শুরু করে, তখন তাদের জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত। ক্রমান্বয়ে মানুষের ক্রমবিস্তার ঘটে এর জ্ঞানের পরিধি বিস্তার লাভ করে। প্রথম পর্যায়ে মানুষের ইতিহাস জ্ঞান ছিল না। ফলে তখন লিখিত উপাদান পাওয়া যায়নি। তাই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হচ্ছে তখনকার ইতিহাস রচনার প্রধান উপাদান। ফলে ইতিহাস প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে আলোচনা করে এবং এগুলোর সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে ইতিহাস রচনা সম্ভব হয়েছে।
অর্থ ছাড়া জীবন অচল, আবার এ অর্থই অনর ্থ ঘটায়। তাই অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে ইতিহাস আলোচনা করে। সভ্যতার শুরুতে মানুষের জীবিকানির্বাহের প্রধান উপাদান ছিল শিকার ও ফলমূল সংগ্রহ। পরবর্তীতে মানুষ কৃষিকাজ শেখে এবং তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্রমবিস্তার হতে থাকে। এসব কর্মকাণ্ডের প্রভাবে মানুষ শহরায়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং গড়ে তোলে বিভিন্ন শিল্প সংগঠন। ফলে সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায় এবং মানুষের জীবনধারা উন্নতি হতে থাকে, যার প্রভাব আজকের আধুনিক পৃথিবী। এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে
ইতিহাস আলোচনা করে।
৮. ধর্মীয় প্রভাব : ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হচ্ছে ধর্মীয় প্রভাব। ধর্ম ভাবে মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছে, এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ ও ক্ষয়ক্ষতি প্রভৃতি ইতিহাস আলোচনা করে। মধ্যযুগে রাষ্ট্রের উপর ধর্মের প্রাধান্য আমরা ইতিহাসের আলোকেই জানতে পারি।
৯. সাহিত্যিক কর্মকাণ্ড : মানবজাতির সাহিত্যিক ইতিহাস জানাও জরুরি। কারণ প্রতিটি জাতির সাহিত্যিক কর্মকাণ্ড থেকে সে জাতির আচার আচরণ, ধর্ম-কর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতি জানা যায়। কারণ সাহিত্য কোন সমাজের দর্পণস্বরূপ। এ দর্পণের সাহায্যেই সমাজের প্রকৃত চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। তাই ইতিহাসের বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা এত বিস্তৃত যে সকল লেখক, দার্শনিক, আবিষ্কারক এবং তাঁদের লেখনী, তত্ত্ব ও আবিষ্কার এর আওতাভুক্ত।
১০. সংস্কার ও সংস্কারক : সমাজ ও রাজনীতি পরিবর্তনশীল। ফলে এ পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে কত ঘটনা যে ঘটে তার খবর কেউ রাখে না। রাখে শুধু ইতিহাস। যুগে যুগে সমাজে বিভিন্ন সংস্কার হয়েছে এবং এর সাথে বিভিন্ন সংস্কারক জড়িত ছিলেন। এসব তথ্য আমরা একমাত্র ইতিহাস থেকেই পাই। তাই সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে
সংস্কার ও সংস্কারক নিয়েই ইতিহাস আলোচনা করে।
১১. উত্থানপতন : যার উত্থান রয়েছে, তার পতনও অনিবার্য। পতন ব্যতীত উত্থানের কল্পনা হাস্যকর। পৃথিবী সৃষ্টির পর বহু সভ্যতার উত্থান ঘটেছে, বিস্তার লাভ করে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে পুনরায় পতন ঘটে তা স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। এসব সভ্যতা ও মানুষের কথা কেউ মনে না রাখলেও মনে রেখেছে ইতিহাস। ইতিহাস যদি এগুলো মনে না রাখত তাহলে মানবসভ্যতার সৃষ্টির রহস্য ও সৃষ্টি সম্পর্কে আমরা জানতে পারতাম না। তাই ইতিহাসের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় সভ্যতা ও মানবজাতির উত্থানপতন।
উপসংহার : আলোচনার শেষ প্রান্তে এসে বলা যায় যে, ইতিহাস শুধু মানুষের অতীত কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে না। এর বিষয়বস্তু ব্যাপক ও বিস্তৃত। ইতিহাস আলোচনা থেকে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, সভ্যতা, মানুষ, উত্থানপতন কোনো বিষয়ই বাদ যায় না। অর্থাৎ পৃথিবীর সবকিছুই ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!