General Knowledge

আধুনিকায়নের বাহন

ভূমিকা : ঐতিহাসিকভাবে আধুনিকায়নের উদ্ভব হয় পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ইউরোপে। ম্যা´ ওয়েবারের
মতে, মধ্যযুগের শেষভাগের স্বায়ত্তশাসিত নগর রাষ্ট্রগুলো, মধ্যযুগের বাণিজ্যিক অগ্রগতি এবং
প্রটেস্ট্যান্ট সং¯কার আন্দোলন পাশ্চাত্য জগতে আধুনিকায়নের সূচনা করেছিল। মূলত: ইউরোপের
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও রেঁনেসার মধ্য দিয়েই আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয়। বর্তমান শতকের
পঞ্চাশের দশকে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে আধুনিকীকরণ তত্ত্বটি নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়।
আধুনিকায়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া। তাই একটি মাত্র উপাদান বা একক মাত্রা দ্বারা একে সীমাবদ্ধ করা
যায় না। আধুনিকায়ন সকল মানুষের পরিবর্তনশীল চিন্তা ও আচরণের সকল দিকের সাথেই সংশ্লিষ্ট।
আধুনিকায়নের উল্লেখযোগ্য উপাদানগুলো হচ্ছে: শিল্পায়ন, নগরায়ন, সামাজিক গতিশীলতা,
গণমাধ্যমের বিকাশ, শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রসার সাধন। আধুনিকায়ন
প্রক্রিয়া আপনা-আপনিই বিকশিত হয় না। আধুনিকায়নের বিকাশ ও প্রসার সাধনের জন্যে বিভিন্ন
বাহন প্রয়োজন। মূলত: বিভিন্ন বাহনের উপর ভিত্তি করেই আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া গতি লাভ করে। এই
ইউনিটে আমরা আধুনিকায়নের যে সকল বাহন নিয়ে আলোচনা করব তা হল :

রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা
রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা নিরূপণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে। দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার
জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। এডমন্ড বার্ক (ঊফসঁহফ
ইঁৎশব) রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে বলেছেন, যখন কোন নির্দিষ্ট স্বীকৃত নীতির
ভিত্তিতে একটি সংগঠিত জনসমষ্টি যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে সচেষ্ট হয়
তখন তাকে রাজনৈতিক দল বলে অভিহিত করা যায়। অধ্যাপক গিলক্রিস্টের মতে, রাজনৈতিক দল
হল সম-রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী নাগরিকগণের সেই সংগঠিত অংশ, যা একটি রাজনৈতিক
সংগঠন হিসেবে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। অধ্যাপক গেটেল (এবঃঃবষষ) বলেছেন,
রাজনৈতিক দল বলতে মোটামুটিভাবে সংগঠিত এমন একটি নাগরিক সম্প্রদায়কে বোঝায় যারা একটি
রাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে কাজ করে এবং যারা তাদের ভোটদান ক্ষমতার দ্বারা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ ও
সাধারণ নীতিগুলোকে কার্যকর করতে চেষ্টা করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দেয়া এ সকল সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, রাজনেতিক দল সম আদর্শভুক্ত
নাগরিকদের একটি সংগঠিত অংশ, যারা নির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে সরকার পরিচালনায় আগ্রহী।
রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য:
রাজনৈতিক দলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যায়, যথা১. রাজনৈতিক দলের সভ্যগণ সম-মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং সেই মতাদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন।
২. প্রতিটি রাজনৈতিক দল বিশেষ একটি মতাদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হলে সামগ্রিকভাবে সমাজের
কল্যাণ সাধনই তার প্রধান উদ্দেশ্য রূপে বিবেচিত হয়।
৩. জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলী নিয়ে নিরন্তর আলাপ-আলোচনার
মাধ্যেমে প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজ মতাদর্শের সমর্থনে জনমত গঠনের জন্য উদ্যোগী হয়।
৪. ব্যাপক সংখ্যক জনগণের সমর্থন লাভ করলে দলীয় কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করার জন্যে প্রতিটি
রাজনৈতিক দলকে সরকার গঠনের দায়িত্ব গ্রহণে প্রস্তুত থাকতে হয়।
৫. পাশ্চাত্যের রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মতে, গণতান্ত্রিক উপায়ে এবং সংবিধানসম্মতভাবে রাজনৈতিক
ক্ষমতা অধিকারের জন্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে চেষ্টা করতে হয়।
রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব:
আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, বিশেষ করে গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে। রাজনৈতিক দল ছাড়া আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায় না। রাজনৈতিক
দল যে সকল কারণে গুরুত্বপূর্ণ তা হলরাজনৈতিক দল জাতীয় স্বার্থ এবং ঐক্যের প্রতীক। রাজনৈতিক দলসমূহ ব্যাপক জাতীয় এবং
আন্তর্জাতিক কর্মসূচীর ভিত্তিতে গঠিত হয়। দলের লক্ষ্য হল, জাতির সর্বাঙ্গীণ স্বার্থ রক্ষা এবং জাতীয়
ঐক্যকে সংহত করা। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বহু সংগঠন গঠিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলের মত
তাদের কোন ব্যাপক কর্মসূচী ও নীতি থাকে না।

রাজনৈতিক দল দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ অগ্রগতির রূপরেখা প্রণয়ন করে। প্রতিটি দলই নিজ
নিজ মতাদর্শ অনুযায়ী কর্মসূচী স্থির করে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে
রাজনৈতিক দল নিজের মতামত পেশ করে। কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব ,
রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীর মাধ্যমেই তার সন্ধান পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ধরনের
সমাধানের পথ-নির্দেশ করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলের এ ভূমিকার ফলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনা
অনেক সহজ হয়ে ওঠে।
রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটায়। একমাত্র রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই সুষ্ঠুভাবে
রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার সম্ভব। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল সভা-সমিতি, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ প্রদর্শন,
প্রচারকার্য, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশ ইত্যাদির মাধ্যমে নিজ নিজ বক্তব্য জনসমক্ষে
প্রকাশ করে। তাদের প্রচারকার্যের মাধ্যমেই জনসাধারণ বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে অবহিত হয় এবং
অনেক তথ্য জ্ঞাত হয়। এর ফলে জনসাধারণের রাজনৈতিক চেতনা প্রসারিত হয়।
রাজনৈতিক দল সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিরোধ করে। গণতান্ত্রিক দেশে সরকার এবং বিরোধী দল
থাকে। সরকার এবং বিরোধী পক্ষ জনসাধারণের কাছে নিজ নিজ বক্তব্য তুলে ধরে। বিরোধী দলের
নিরন্তর সমালোচনা সরকার পক্ষকে নিজের ভুল-ক্রটি সম্পর্কে সজাগ করে তোলে। বিরোধী
রাজনৈতিক দলের এ সতর্ক প্রহরার জন্যই কোন সরকারের পক্ষে যথেচ্ছাচারী হওয়া সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক দল কেবল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নিজের সদস্যদেরই সংগঠিত করে না, সাধারণ
অরাজনৈতিক মানুষকেও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ করে।
দল রাজনৈতিক জীবন এবং প্রশাসনে সুশৃঙ্খল পরিবেশ গড়ে তোলে । বর্তমান রাজনৈতিক দলসমূহ
সংগঠিতভাবে মতাদর্শ, কর্মসূচী এবং দেশের সমস্যা সম্পর্কে নিজ নিজ বক্তব্য পেশ করে। এর ফলে
জনসাধারণের পক্ষে বিভিন্ন দলের কর্মসূচী সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা করা সম্ভব হয়। কিন্তু দেশে
কোন রাজনৈতিক দল না থাকলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে স্বতন্ত্রভাবে নিজ নিজ
বক্তব্য পেশ করতে হত। সাধারণ মানুষের অগণিত মতামতের মধ্য থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা
সম্ভব হয় না। দলহীন অবস্থা সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেও সমস্যা সৃষ্টি করত।
রাজনৈতিক দলকে অনেকে উন্নত সরকার গঠনের উৎস নামে অভিহিত করেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে
কোন ব্যক্তিই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও নির্বাচিত হবার সুযোগ পায়। আধুনিক দল-শাসিত সরকারের
বেশির ভাগ সদস্য কোন-না-কোন দলের সমর্থনে নির্বাচিত হন। ভোটদাতাদের সমর্থনলাভের জন্য
প্রত্যেক দলই উপযুক্ত প্রার্থী মনোনীত করে। এ কারণেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতাসম্পন্ন প্রার্থীদের
মনোনীত করার ফলে তাদের দ্বারা গঠিত সরকারও নিপুণ হয়ে ওঠে।
রাজনৈতিক দল দেশের মধ্যে ব্যাপক মতৈক্যের পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। রাজনৈতিক
দলসমূহের মধ্যে যেমন মতাদর্শ ও কর্মসূচীগত পার্থক্য থাকে, তেমনি অনেক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক
সমস্যা সম্পর্কে তাদের মধ্যে মতৈক্যও লক্ষ্য করা যায়। এ মতৈক্যের ফলে সামাজিক-রাজনৈতিক
উত্তেজনা এবং রাজনৈতিক বিরোধের মাত্রা বহুল পরিমাণে হ্রাস পায়।
রাজনৈতিক দল জনসাধারণকে রাজনৈতিক দিক থেকে সক্রিয় করে তোলে। রাজনৈতিক কার্যাবলীতে
অংশগ্রহণের প্রধান মাধ্যম হল দল। জনসাধারণ সক্রিয়ভাবে যত বেশি রাজনৈতিক কার্যাবলীতে
অংশগ্রহণ করে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনসাধারণের আগ্রহ এবং উৎসাহ তত বেশি বৃদ্ধি পায়।
এর ফলে সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত আরও বেশি সংগঠিত আকার ধারণ করে।
রাজনৈতিক দল হল জমনত গঠন এবং রাজনৈতিক মতামত ও বিশ্বাস সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম।
রাজনৈতিক দল সভা-সমিতি, আইনসভা, প্রচার, পুস্তুক-পুস্তিকার মাধ্যমে সুষ্ঠু এবং কল্যাণকামী
মতামত গড়ে তোলে। রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসের উম্মেষেও রাজনৈতিক দল মুখ্য ভূমিকা
গ্রহণ করে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনুকূলে যত বেশি বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ গড়ে ওঠে, রাজনৈতিক
ব্যবস্থার স্থায়িত্বও তত বেশি বৃদ্ধি পায়।

রাজনৈতিক দল শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টি করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে
দল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের হাতেই সরকার গঠনের দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। সরকার
জনসাধারণের কাছে নিজের কর্মসূচী রূপায়ণের জন্যে দায়বদ্ধ। জনসাধারণ বিভিন্ন দলের কর্মসূচী
বিশ্লেষণের পরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কোন্ দলকে তারা সমর্থন জানাবে। বিরোধী পক্ষ একদিকে যেমন
সরকার পক্ষকে সমালোচনা করে তাকে সঠিক পথে চলতে বাধ্য করে, অন্যদিকে পরবর্তী নির্বাচনে
জয়লাভের স¤ভাবনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকে। এর ফলে রাজনৈতিক পরিবর্তন
শান্তিপূর্ণ পথে সংগঠিত হবার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক দল সনাতন সামাজিক-সংগঠনের পরিধি হতে মানুষকে বৃহত্তর সংগঠনে একত্রিত করে।
ফলে বর্ণগত, গোষ্ঠীগত চেতনা ভেঙ্গে গিয়ে আধুনিক চেতনার উম্মেষ ঘটে। এছাড়া, রাজনৈতিক দল
ব্যাপক গতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে জনসাধারণকে আধুনিকতাগামী করতে সক্ষম হয়। এ কারণে
রাজনৈতিক দলকে আধুনিকায়নের বাহক হিসেবে অভিহিত করা যায়।

সারকথাঃ রাজনেতিক দল সম আদর্শভুক্ত নাগরিকদের একটি সংগঠিত অংশ, যারা নির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে
সরকার পরিচালনায় আগ্রহী। রাজনৈতিক দলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন- এক বা অভিন্ন
আদর্শের অনুসরণ, সামগ্রিকভাবে সমাজের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্য, নিজের অবস্থানের পক্ষে জনমত
গঠনের প্রচেষ্টা, ক্ষমতা দখল বা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের অভিপ্রায়। প্রতিটি আধুনিক রাজনৈতিক
ব্যবস্থাতে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব রয়েছে। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব
বেশী। রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা, দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অগ্রগতির রূপরেখা প্রণয়ন
করে। এছাড়া, রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার, স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিরোধ, জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক
চেতনার প্রসার ও অংশগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টিতে রাজনৈতিক দল সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!