আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল সেগুলো আলোচনা কর।
অথবা, আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনগুলো উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : রাজনৈতিক দমন পীড়নের মাধ্যমে আইয়ুব খান তার বিরোধী শক্তি এবং গণআন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। সামরিক শাসন জারি ও আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের পর রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়। মৌলিক অধিকার স্থগিত রাখা হয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সভা সমাবেশ
নিষিদ্ধ এবং সংবাদপত্রের উপর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। পাকিস্তানের উভয় প্রদেশের অসংখ্য রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। অনেকে অন্তরালে চলে যায় এরূপ পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন ছাত্র সমাজ স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করতে থাকে। ছাত্রসমাজের এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শেষপর্যন্ত আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।
আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন : আইয়ুব খান পূর্ব বাংলার জনগণের উপর উৎপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত করেছিলেন। তাঁর এ অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছাত্র সংগঠন, সাংবাদিক, কিছু সাংস্কৃতিক কিছু রাজনীতিবিদ প্রতিবাদ করার উদ্দেশ্যে আন্দোলন সংঘঠিত করেছিল। নিচে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল সেগুলোর বর্ণনা দেয়া হলো :
১. ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন : আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণের পর পূর্ব পাকিস্তানে স্বৈরাচারী শাসন শুরু করে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকায় আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের মূল উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল ছাত্রসমাজ। ১৯৬১ সালের ৩০ ডিসেম্বর ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের একটি গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতা অইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের জন্য গোপনে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং একত্রে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন সংগঠনে সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৬২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্দোলনের দিনক্ষণ ঠিক হয়। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতারের ফলে আন্দোলনের সুযোগ তৈরি হয়। ‘৬২ এর ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইয়ুব খান শাসনতন্ত্র ঘোষণা করলে তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ আন্দোলন শুরু করে এবং পরে তা সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
২. হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার এবং ছাত্র আন্দোলন : ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি আইয়ুব সরকার রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে হঠাৎ করেই করাচিতে সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। ৩১ জানুয়ারি এ খবর প্রকাশিত হলে ছাত্র সমাজ বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এবং সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির জন্য রাজপথে প্রকাশ্য মিছিল করে। ৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সমাজ আইয়ুব খানকে ঘেরাও করার কর্মসূচি গ্রহণ করে। সরকার ভীত হয়ে ৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে এবং বহু ছাত্রনেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় ২২৯ জন গ্রেফতার হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়। বরিশাল, সিলেট, খুলনা, নোয়াখালী ও কুমিল্লাতে ছাত্র আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে।
৩. শাসনতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন : আইয়ুব খান ১৯৬২ সালে প্রচলিত সংবিধানকে নাকচ করে সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন। কিন্তু সামরিক আইন ব্যবস্থা জারি থাকায় উক্ত সংবিধানের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬২ সালের ৮ জুন নতুন সংবিধান কার্যকর হয়। উক্ত সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি সম্পর্কে কোনো মতামত ব্যক্ত হয়নি। ১ মার্চ শাসনতন্ত্র ঘোষিত হলে ছাত্ররা আন্দোলনের নামে নতুন সংবিধান বিরোধী আন্দোলন স
ারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ৬২ এর ছাত্র অন্দোলন তিনটি দাবি জানিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য আইয়ুব বিরোধী ধর্মঘট আহবান করে। দাবি তিনটি হলো :
ক. নতুন সংবিধান বাতিল,
খ. পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা,
গ. সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দান। ছাত্রসমাজের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছিল। ১০ এপ্রিল রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ নামে কঠোর আইন জারি হলে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়, কিন্তু রাজনৈতিক কার্যক্রম
নিষিদ্ধ রাখা হয়। এরূপ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো’ ৬২ সংবিধান বাতিল করে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানায় । এরূপ পরিস্থিতিতে ছাত্রদের চলমান আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে।
৪. শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও ছাত্র আন্দোলন : ১৯৬২ সালে শরীফ শিক্ষা কমিশন শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট পেশ করে। ‘৬২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত এ আন্দোলন বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন নামে সুপরিচিত। আইয়ুব খান শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার এবং নানাবিধ মিথ্যা আশ্বাস প্রদান করেন। স্কুল কলেজের সংখ্যা সীমিত রাখা শিক্ষা ব্যয়ে ৮০% অভিভাবক কর্তৃক বহন করা প্রভৃতি ছিল শরীফ কমিশন শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ। উক্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে ঢাকা কলেজে ছাত্ররা প্রতিবাদে ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম গঠন করে। জগন্নাথ কলেজ, কায়েদে আযম কলেজ, ইডেন কলেজও উক্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্রসভা করে। উক্ত প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা যোগদান করলে প্রতিবাদ তীব্র রূপ লাভ করে এবং ছাত্ররা ১৫ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে ছিল। কার্জন হল ও জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের মিছিলে শসস্ত্র বাহিনী গুলি চালায়।
৫. ১৯৬৪ সালের ছাত্র আন্দোলন : ১৯৬৪ সালের ৭ জানুয়ারি অবাঙালি মুসলমানরা ঢাকা শহরে ও আশেপাশে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু করে। হিন্দুদের উক্ত দাঙ্গা থেকে রক্ষার জন্য আমির হোসেন চৌধুরী এবং নটরডেম কলেজের ক্যাথলিক ফাদার নোভাক নিহত হয়। উক্ত পরিস্থিতিতে ছাত্র সমাজ সোচ্চার হয়ে উঠে। দাঙ্গা প্রতিরোধে ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে ছাত্ররা। ১৯৬৪ সালে ঢাকা’ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে . উঠে আবার আন্দোলন। গভর্নর মোমেন খান রাজবন্দিদের দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করলে ছাত্ররা তাঁর উপর ক্ষুব্ধ হয়।
৬. ছয়দফা : ১৯৬৬ সালে ছয়দফা উত্থাপন করা হয়। ছয়দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। ছয়দফা দাবি উত্থাপিত হলে আইয়ুব খান এ দাবিকে বিছিন্নতাবাদী বলে ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক দমন শুরু করে এবং শেখ মুজিবসহ বহু রাজনৈতিক নেতাকে বন্দি করে। এরূপ রাজনৈতিক শূন্যতায় আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের মূল দায়িত্ব পালন করে ছাত্র
সমাজ। ছাত্র সমাজ ছয় দফাকে গণদাবিতে পরিণত করেছিল।
৭. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান : ছয় দফা আন্দোলন দমনের জন্য আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে। যা আগরতলা মামলা নামে খ্যাত। এ ষড়যন্ত্র মূলক মামলার বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজ তীব্র গণআন্দোলন শুরু করে। ছাত্র সমাজের এ গণআন্দোলন গণদাবিতে পরিণত হয় এবং এ স্বতঃস্ফূর্ত
গণআন্দোলনের মুখে ২৫ মার্চ ‘৬৯ আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সামরিক শাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণ করে পূর্ব পাকিস্তানের উপর নিপীড়ন ও বৈষম্য শুরু করে। ছাত্র সমাজ আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ছাত্রসমাজের মিছিল, মিটিং সভা সমাবেশ, ধর্মঘট শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খানের পতন ঘটায়। বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের ইতিহাসে ছাত্র সমাজের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।