General Knowledge

অনুমান সম্পর্কে বৌদ্ধদার্শনিক অভিমত ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বৌদ্ধ দর্শনের অনুমান তত্ত্ব বিশ্লেষণ কর।
অথবা, অনুমান সম্পর্কে বৌদ্ধ দার্শনিকদের অভিমত আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
গৌতম বুদ্ধের (খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দ- খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দ) বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে সে মতবাদই ‘বৌদ্ধদর্শন’ বা ‘বৌদ্ধধর্ম।’ কালক্রমে বৌদ্ধদর্শন ও ধর্ম সিংহল, ব্রহ্মদেশ, শ্যাম, তিব্বত, কোরিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করে। বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম ও দর্শনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রায় ত্রিশটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে বলে জানা যায়। S Chatterjee and D. Datta ‘An Introduction to Indian Philosophy , “Buddhism,
thought primarily an ethical-religious movement, thus came to give birth to about thirty schools,
not counting the minor one.” (Page-140) দর্শন চর্চার ক্ষেত্রে বৌদ্ধগণ জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় অনুমান সম্পর্কিত আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। নিম্নে প্রশ্নপত্রের আলোকে অনুমান সম্পর্কে বৌদ্ধদার্শনিক অভিমত ব্যাখ্যা করা হলো :
অনুমান : ‘অনুমান’ শব্দের শব্দগত অর্থ ‘পরবর্তী জ্ঞান’। পূর্ববর্তী জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল পরবর্তী জ্ঞানই অনুমান। অনুমান স্থলে পূর্ববর্তী জ্ঞান হলো : (১) পক্ষে (পর্বতে) হেতুর (ধূমের) জ্ঞান এবং (২) হেতু ও সাধ্যের (আগুনের) ব্যাপ্তি সম্বন্ধের স্মৃতিজ্ঞান। এ দুটি জ্ঞান হওয়ার পর অনুমিতি, অর্থাৎ পক্ষে সাধ্যের জ্ঞান হয়। বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে অনুমান দু’প্রকার। যথা :
ক) স্বার্থানুমান এবং খ) পরার্থানুমান।
ক. স্বার্থানুমান : যে অনুমান কেউ নিজের জন্য করে তাকে স্বার্থানুমান বলে। কাৰ্য্যহেতুক ও স্বভাবহেতুক অনুমান—দুই স্বার্থানুমান হতে পারে।
খ. পরার্থানুমান : যে অনুমানে, কেউ অন্যের কাছে, বাক্যের সাহায্যে তিনটি ধর্ম বিশিষ্ট (নির্দোষ) হেতুর বর্ণনা করে, সাধ্য অনুমান করে তাকে পরার্থনুমান বলে। তাই পরার্থনুমানকে বাক্যাত্মক ও স্বার্থনুমানকে জ্ঞানাত্মক বলে। বৌদ্ধ মতে, অনুমান মূলত জ্ঞানাত্মকই, বাক্যাত্মক নয় ।
হেতুর লক্ষণ : বৌদ্ধ মতে, যে পদার্থের পক্ষে থাকে এবং সাধ্যের দ্বারা ব্যাপ্য হয় তাকে ‘হেতু’ বলে। হেতুর পক্ষে থাকাকে ‘পক্ষধর্মতা’ এবং সাধ্য দ্বারা ব্যাপ্য হওয়াকে ‘ব্যাপ্তিবিশিষ্টতা’ বলে। হেতুর পক্ষধর্মতা ও ব্যাপ্তিবিশিষ্টতা সম্পর্কে নিশ্চয়াত্মক জ্ঞানের ফলে, সাধ্যের আকার-প্রতিভাসী নিশ্চয়াত্মক জ্ঞান হয়। এ সাধ্যজ্ঞানই অনুমিতি। নির্দোষ কারণেই নির্দোষ কার্য উৎপাদন করতে পারে । নির্দোষ হেতু থেকেই নির্দোষ অনুমিতি জন্মাতে পারে। হেতুকে নির্দোষ হতে গেলে, তার তিনটি ধর্ম থাকা দরকার। পক্ষে থাকা (পক্ষবৃত্তিত্ব), সপক্ষে থাকা (সপক্ষবৃত্তিত্ব) ও বিপক্ষে না থাকা (বিপক্ষ অবৃত্তি)—এ তিনটিই নির্দোষ হেতুর ধর্ম। যেমন- ‘পৰ্বত ধূমবান’ তাই তা অগ্নিমান’- এই অনুমিতিটি নির্দোষ হেতু উৎপন্ন। তাই অনুমিতিটি নির্দোষ। এই অনুমিতির হেতু ‘ধূম’ পক্ষে (পর্বতে) থাকে, সপক্ষে (সাধ্য অগ্নিবিশিষ্ট স্থলে,-মহানস, চত্বর প্রভৃতিতে) থাকে এবং বিপক্ষে (সাধ্য ‘অগ্নি’ যেখানে নেই জল, হ্রদ প্রভৃতিতে) থাকে না। ফলে হেতু ত্রি-রূপ (ধর্ম) বিশিষ্ট’ই। আলোচ্য অনুমিতিরই (পূর্ববর্তী জ্ঞানের) পূর্ববর্তী জ্ঞান দুটি হলো-১। পর্বতে (পক্ষে) ধূমের হেতুর) প্রত্যক্ষজ্ঞান এবং ২। ধূম ও অগ্নির (সাধ্যের) ব্যাপ্তি-সম্বন্ধের স্মরণ।
ব্যাপ্তির স্বরূপ : বৌদ্ধ মতে অবিনাভাবত্বই ব্যাপ্তির স্বরূপ। সর্বত্রই সাধ্যের সঙ্গে হেতুর সমান অধিকরণে থাকা এবং সাধ্যের অভাবের অধিকরণে হেতুর না থাকাই ‘অবিনাভাবত্ব। যে কোন ব্যাপ্তিই অংশত অন্বয়াত্মক, অংশত ব্যতিরেকাত্মক।
ব্যাপ্তি নির্ণয় : বৌদ্ধগণ বলেন, দু’রকম সম্বন্ধ দেখে, ব্যাপ্তি নির্ণীত বা জ্ঞাত হতে পারে। এ সম্বন্ধ দুটি হলো : কার্যকারণ ভ াবসম্বন্ধ ও তাদাত্মসম্বন্ধ। হেতু দু’প্রকার। যথা : কার্যহেতু ও স্বভাবহেতু। কার্যহেতু কিংবা স্বভাবহেতুকে দেখে সাধ্যের অনুমান করা হয়। কার্যের উৎপত্তি কারণের অধীন। কার্য হেতু, কারণ সাধ্য। তাই বৌদ্ধগণ বলেন, কার্যহেতুতে কারণের (সাধ্যের) অধীন উৎপত্তিমত্তা থাকে। আবার স্বভাবে স্বভাবীর তাদাত্ম্য থাকে। কার্যকারণ ভাবসম্বন্ধ ও তাদাত্ম্যসম্বন্ধ ছাড়া অন্য কোন সম্বন্ধই ব্যাপ্তির সাধন করতে পারে না। যে কোন সম্বন্ধকেই ব্যাপ্তির সাধক বলে মানলে যে কোন পদার্থই অন্য যে কোন পদার্থের হেতু হতে পারে। কারণ এমন অনেক সম্বন্ধ আছে-কালিক সম্বন্ধ তার অন্যতম, যার দ্বারা জগতের সকল পদার্থ একে অন্যের সঙ্গে সম্বন্ধ থাকে। বস্তুত সেভাবে অনুমান হয় না। কার্যহেতু কিংবা স্বভাবহেতু থেকেই কারণ (সাধ্য) কিংবা স্বভাবীর (সাধ্য) অনুমান করা যায়। হেতু দু’রকম বলে অনুমানও দু’রকম । যথা : কার্যহেতুক অনুমান ও স্বভাবহেতুক অনুমান।
কার্যহেতুক ও স্বভাবহেতুক অনুমানের ব্যাপ্তি নির্ণয় রীতি : কার্যহেতুক অনুমিতির জনক ব্যাপ্তি নির্ণয়ের রীতি সম্পর্কে বৌদ্ধগণ
বলেন, যে যে স্থানে (সপক্ষে) হেতু (কার্য) থাকে, সেখানে কারণের (সাধ্য) বর্তমানতার নিশ্চয়জ্ঞান হয়। একে ‘অন্বয়-নিশ্চয়’ বলে। তারপর যে যে স্থানে (বিপক্ষে) সাধ্য (কারণ) থাকে না, সেখানে হেতুর অবর্তমানতার নিশ্চয়জ্ঞান হয়। একে ‘ব্যতিরেকী- নিশ্চয়’ বলে। বৌদ্ধগণ বলেন, যেমন মহানস, চত্বর প্রভৃতি সপক্ষে ধূম থাকে। সেখানে অগ্নির বর্তমানতা সম্পর্কে নিশ্চয় হয়। অতঃপর জল, হ্রদ প্রভৃতি বিপক্ষে অগ্নি থাকে না এবং সেখানে ধুমও যে থাকে না, সে বিষয়ে নিশ্চয় জ্ঞান হয়। এভাবে অন্বয় ও ব্যতিরেকের নিশ্চয়ের সাহায্যে হেতু ও সাধ্যে ব্যাপ্তি নির্ণীত হয়। এ রীতিতে হেতু ও সাধ্যের কার্যকারণ সম্বন্ধ জানা যায়। এখানে কার্যকারণ স্বভাসম্বন্ধই ব্যাপ্তিসম্বন্ধ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বৌদ্ধদর্শন জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় অনুমান সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তা দার্শনিক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!