অগাস্ট কোঁৎ-কে কেন সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়?
অথবা, সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে কেন অগাস্ট কোঁৎ-কে আখ্যায়িত করা হয়।
অথবা, অগাস্ট কোঁৎ-কে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সাধারণত মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কই সমগ্র সমাজ। আর এ সমাজ নিয়ে যে বিজ্ঞান আলোচনা করে তা হলো সমাজবিজ্ঞান। মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশে বিভিন্ন পর্যায়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের দার্শনিক, চিন্তাবিদ, মানুষের সমাজজীবন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেছেন। একেকজন একেক দৃষ্টিতে সমাজ ও সমাজবদ্ধ মানুষের বিভিন্ন সমস্যা তথা জীবনযাপন পদ্ধতি আলোচনা করেছেন।
অগাস্ট কোঁৎ এর পরিচয় : ফরাসি দার্শনিক, চিন্তাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী অগাস্ট কোঁৎ ১৭৯৮ সালে ফ্রান্সের মন্টেপোলিয়ারে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর জীবন পরিধি বিস্তৃত না হলেও চিন্তাজগতে এ মনীষীর মৌলিক অবদান অনস্বীকার্য । অগাস্ট কোঁৎ সর্বপ্রথম সমাজবিজ্ঞান সম্পৰ্কীয় বিক্ষিপ্ত চিন্তা, দর্শন ও তত্ত্বসমূহ একটি বিশেষ বিজ্ঞানের অধীনে এনে সামাজিক বিজ্ঞানের ভিত্তি ও দৃষ্টিকোণ তৈরি করেছেন। কোঁৎ এর রচনাবলির মধ্যে Positive Philosophy’ ও ‘Polity’ উল্লেখযোগ্য।
সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে কোঁৎ এর অবদান : সমাজ সম্পর্কিত আলোচনার সূত্রপাত অতীত থেকে শুরু হলেও বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার সূত্রপাত ঘটান ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ অগাস্ট কোঁৎ সর্বপ্রথম ‘Sociology’ শব্দটির জন্ম দেন। যা ল্যাটিন শব্দ ‘Socious’ এবং গ্রিক শব্দ ‘Loges’ এর সমন্বয়ে গঠিত। Socious শব্দের অর্থ সমাজ এবং Logs শব্দের অর্থ বিজ্ঞান। অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান হলো Science of society বা সমাজের বিজ্ঞান। এ বিজ্ঞানের নামকরণ বা উৎপত্তি হয় ১৮৩৯ সালে। অগাস্ট কোঁৎ রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Positive Philosophy’ ও ‘Polity’ তে সমাজ বিশ্লেষণে Positive method এর কথা উল্লেখ আছে। তাছাড়া তিনি সমাজবিজ্ঞানকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা : ১. সামাজিক স্থিতি (Social statics) ও ২. সামাজিক গতি (Social
dynamics)। অগাস্ট কোঁৎ সমাজের উৎপত্তির ক্রমবিকাশকেও তাঁর Scientific method দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন। এজন্য এ মনীষীকে তাঁর মৌলিক অবদানের জন্য সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। নিম্নে তাঁর অবদানকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো :
দৃষ্টবাদ (Positivism) : সমাজ বিশ্লেষণে August Comte যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন তাকে বলা হয় Positive method. অর্থাৎ দৃশ্যমান সকল বিষয় নিয়ে Positive দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করার নামই হলো Positivism বা দৃষ্টবাদ। ১৮৩০ থেকে ১৮৪২ সালের মধ্যে রচিত তাঁর বিখ্যাত ‘Positive Philosophy’ গ্রন্থের ৬ খণ্ডের মধ্যে তিনি
দৃষ্টবাদকে ব্যাখ্যা করেছেন সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে। অগাস্ট কোঁৎ এর Positivism এর ৭টি Stage বা Dimension রয়েছে। সেগুলো হলো ঃ
- Scientific spirit is the study of imagination to observation and reason to facts : অর্থাৎ বিজ্ঞানের মর্মবাণী হলো কল্পনাকে দৃষ্টবাদ দ্বারা এবং বিচারকে সত্য দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা। কোঁৎ এর মতে, “কল্পনার কোন স্থান নেই। বিচারবুদ্ধিকে সত্য বা বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
- Reason and observation are the two co-ordination of scientific method: বিচারবুদ্ধি ও প্রত্যক্ষণ হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তিস্বরূপ । Reason কে বাদ দেয়া যাবে না এবং Fact থাকবে। Reason না থাকলে Fact থাকবে না।
- The predictive quality of science is infact to control the future : সমাজবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হলো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা করা । এমনকি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের যে গবেষণা তার মূল উদ্দেশ্য হলো ভবিষ্যদ্বাণী করা।
- Order and progress refer to social statics and social dynamics : দৃষ্টবাদ হচ্ছে শৃঙ্খলা ও প্রগতি। কোঁৎ এর মতে, “পদ্ধতিগত দিক থেকে সমাজবিজ্ঞান উভয় বিষয়কে বিশ্লেষণ করে। সামাজিক শৃঙ্খলাকে বিচার করেছে Social statics এবং প্রগতিকে বিচার করেছে Social dynamics।” এ দুটির সমন্বয় ছাড়া সমাজবিজ্ঞান প্রাসঙ্গিকতা পেতে পারে না।
- Society should be study as a whole not should be separate as a component of parts: সমাজকে বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্লেষণ করলে বা Social phenomena কে ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভাগ করে বিচার করলে কোন ধারণা জন্মায় না, বরং সামগ্রিকভাবে প্রত্যক্ষণ করতে হবে।
- Evolutionary progress is essential : বিবর্তনের মাধ্যমে যে গতিশীলতা অর্জন হয় তা একটা পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। তাঁর মতে, প্রগতিবাদীরা যে প্রগতির কথা বলেছেন তা বিপ্লবের মাধ্যমে। বিবর্তনের ধারায় হচ্ছে।
- Social statics : Social statics একটা নির্দিষ্ট সময় সামাজিক চিত্র তুলে ধরছে। সামাজিক স্থিতি ছাড়া সামাজিক প্রগতি অর্থহীন। তিনি সামাজিক স্থিতির একক হিসেবে পরিবারের কথা তুলে ধরেন।
অগাস্ট কোঁৎ দৃষ্টবাদকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন। এগুলো নিরূপ : - বিজ্ঞানের দর্শন (Philosophy of the science) : দৃষ্টবাদকে Philosophy of the science বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ মানুষ স্বীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিজ্ঞানের সৃষ্টি করেছে।
- বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম বা নীতিশাস্ত্র (Scientific religion and ethics) : বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম বা নীতিশাস্ত্র অতিপ্রাকৃত শক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়, বরং তা মানবধর্মকে মেনে নেয়।
- দৃষ্টবাদী রাজনীতি (Positive politics) : দৃষ্টবাদী রাজনীতি হচ্ছে যুদ্ধবিরোধী রাজনীতি, যা সকল প্রকার ধ্বংসাত্মক রাজনীতিকে পরিহার করে মানবসমাজের একটা উপাদানের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। সমাজবিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের প্রধান দুটি ধারা (Two major parts of sociological study) :
অগাস্ট কোঁৎ সমাজবিজ্ঞানকে পাঠ করার ক্ষেত্রে দুটি ধারণা প্রদান করেছেন। যথা :
১. সামাজিক স্থিতি (Social statics) ও
সামাজিক গতি (Social dynamics)।
১. সামাজিক স্থিতি (Social statics) : সামাজিক স্থিতি সমাজের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে আলোচনা করে।
যেমন- পরিবার, অর্থনীতি ও রাজনীতি ইত্যাদি। অগাস্ট কোঁৎ এর মতে, “The statical study of sociology consist in the investigations of laws of action and reaction of different parts of the social system.”
২. সামাজিক গতি (Social dynamics) : সামাজিক গতি পুরো সমাজকে বিশ্লেষণের একক হিসেবে ধরে নেয় এবং কিভাবে উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটানো যায় সময়ের সাথে সংগতি রেখে তা ব্যাখ্যা করে। অগাস্ট কোঁৎ এর মতে, “We must remember that the laws of social dynamics are most recognisable when they relate to the largest societies.”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, আধুনিক শিল্প সমাজে কোঁৎ এর তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতিতে কার্যকর না হলেও সমাজবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মর্যাদা তিনিই দিয়েছেন। এ মনীষী এমন ব্যক্তি যিনি সমাজ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কারণ অনুসন্ধানে সর্বোচ্চ আত্মনিয়োগ করেছিলেন।