অথবা, অখণ্ড স্বাধীন বাংলা সম্পর্কিত ১৯৪৭ সালের চুক্তি সম্পর্কে যা জান লিখ ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতবর্ষ কখনো একটিমাত্র জাতির রাষ্ট্র ছিল না। ভারতের মানুষের মধ্যে ধর্ম, বর্ণ, পেশা, বৃত্তি, শ্রেণি ইত্যাদি নিয়ে বিভক্তি ছিল। স্বাধীনভাবে তারা বিকশিত হলে ভারতবর্ষের একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম হতো। ঠিক এমনই একটি জাতি হলো বাঙালি জাতি ভাষা, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদির কারণে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বাংলায় জাতিভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা ছিল অন্যতম। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তিকরণ যখন প্রায় চূড়ান্ত এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করে যা ছিল স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাব।
বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি : ১৯৪৭ সালের ২০ মে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের নেতাদের এক সম্মেলনে আহ্বান করা হয়। এ সভা অনুষ্ঠিত হয় শরৎচন্দ্র বসুর কোলকাতার ১ নং উডবার্ন পার্কের বাসভবনে। সেখানে মুসলিম লীগের হোসেন সোহরাওয়ার্দী, ফজলুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, আবুল হাশিম এবং এ. এম. মানিক উপস্থিত ছিলেন। কংগ্রেসের শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শঙ্কর রায় ও সত্যরঞ্জন বখশী উপস্থিত ছিলেন। সভায় আলোচনা করে বাংলা সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে সকলে একমত হয় এবং তারা স্বাধীন অখণ্ড, বৃহত্তম বাংলা চুক্তি স্বাক্ষরিত করে। এ চুক্তিতে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করেন আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে শরবসু স্বাক্ষর প্রদান করেন।
বসু-সোহারাওয়ার্দী চুক্তির ধারা বা বৈশিষ্ট্য :
১. বাংলা হবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভারতের অন্যান্য অংশের সাথে বাংলার কি কি সম্পর্ক হবে তা সে নিজে নির্ধারণ করবে।
২. হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা অনুপাতে আসন সংখ্যা বণ্টন করে আইনসভার নির্বাচন হবে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে এ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। হিন্দু ও তফশিলি হিন্দুদের মধ্যে আসন বণ্টন করা হবে।
উভয়ের সম্মতিক্রমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে অথবা জনসংখ্যার অনুপাতে। নির্বাচন হবে একটি এলাকা থেকে একাধিক প্রার্থী নির্বাচনমূলক (Multiple) এবং ভোট হবে বণ্টনধর্মী (Distributive) ও সর্বোচ্চ আসন সংখ্যাভিত্তিক (Cumulative) নয়। যদি কোনো প্রার্থী নিজ সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট লাভ করে এবং অন্য সম্প্রদায়ের ২৫% ভোট পায় তবে সে নির্বাচিত বলে গণ্য হবে। যদি কোনো প্রার্থীই এ শর্ত পূরণ করতে না পারে তবে যে তার সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে সে নির্বাচিত বলে গণ্য হবে।
৩. স্বাধীন বাংলার এ পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকার মেনে নিলে অথবা বাংলা বিভক্ত হবে না এমন ঘোষণা দিলে বাংলার বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হবে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ বাদে সমসংখ্যক হিন্দু-মুসলিম সদস্য নিয়ে
একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে এর প্রধানমন্ত্রী হবে একজন মুসলমান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন একজন হিন্দু।
৪. ‘অবিভক্ত বাংলার নতুন সংবিধান অনুযায়ী আইনসভা ও মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সামরিক বাহিনী ও পুলিশসহ সকল চাকরিতে সমান অংশ থাকবে। এসব চাকরিতে শুধু বাঙালিদের নিয়োগ করা হবে।
৫. ইউরোপীয় সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে বঙ্গীয় আইনসভায় একটি সংবিধান পরিষদ গঠন করা হবে যেখানে মুসলমান ও অমুসলমান সদস্য সংখ্যা হবে যথাক্রমে ১৬ জন মুসলমান এবং ১৪ জন হিন্দু।
প্রতিক্রিয়া :
মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়া : প্রথম দিকে মুসলিম লীগ এ প্রস্তাবের সমর্থন করে কিন্তু এ প্রস্তাব প্রকাশ হওয়ার পর মুসলিম লীগের অন্যান্য সদস্যরা প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা শুরু করে। আ
করাম খাঁ, খাজা নাজিমউদ্দিন এর সমালোচনা করেন।
কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া : অখণ্ড স্বাধীন বাংলার প্রস্তাবের প্রথম থেকে কংগ্রেসের হাইকমান্ডররা বিশেষ করে জওহরলাল
নেহেরু ও সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল এর বিরোধিতা করেন। প্যাটেল বলেন যে, “বাংলার অমুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে বাংলাকে অবশ্যই বিভক্ত করতে হবে।”
ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া : বাংলার গভর্নর ফ্রেডরিখ বারোজ অখণ্ড স্বাধীন বাংলার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। অন্যদিকে, ভারত সচিব লিস্টওয়েনও বাংলা অবিভক্তের পক্ষে ছিলেন। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেন। ‘সর্বভারতীয় দৃষ্টিকোণ’ থেকে বিচার করতে হয়েছে বলে এ বিষয় নিয়ে তার মতামত পরিষ্কার ছিল না।
লর্ড মাডন্ট ব্যাটেন চেয়েছিলেন যে, সোহরাওয়ার্দী স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব পরিত্যাগ না করেন কিন্তু কংগ্রেসের বিরোধিতার ফলে স্বাধীন বাংলা সম্পর্কে সকল আশা দূরীভূত হয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে ঐ বছরের প্রথম দিকে বাংলার দু’ অংশকে একত্র করে অখণ্ড ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যোগ নেন। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ও শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের বিরোধিতার কারণে এ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন পরিকল্পনায় বাংলা বিভাগের কথা বলা হয়। পরবর্তীতে সোহরাওয়ার্দী বাংলা বিভাগের জন্য আবেদন করলে তখন বাংলা বিভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পূর্ব বাংলা পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট পশ্চিম বাংলা ভারতের সাথে যুক্ত হয় এবং অবিভক্ত বাংলার স্বপ্ন এখানেই ভঙ্গ হয়।

ডিগ্রী অনার্স মাস্টার্স পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে পেতে Whatsapp এ ম্যাসেজ করুন। Whatsapp 01979786079